বিয়ের পরেও ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে। প্রতীকী এ ছবির মডেল ফারজাদ, মিলি বাশার ও ইরানি
বিয়ের পরেও ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে। প্রতীকী এ ছবির মডেল ফারজাদ, মিলি বাশার ও ইরানি

বিয়ের পরও ছেলেকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা করছেন না তো

বিয়েটা পারিবারিকভাবে ধুমধামের সঙ্গেই হয়েছিল। তন্ময়ের (ছদ্মনাম) মা নিজে পছন্দ করে সায়মার (ছদ্মনাম) পরিবারের সঙ্গে সম্বন্ধ করেছিলেন। বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বদলে যায় দৃশ্যপট। সায়মা ডানে গেলেও তাতে দোষ খুঁজে পান তন্ময়ের মা, বাঁয়ে গেলেও তা–ই।

সেই সঙ্গে চলছিল তন্ময়ের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের মত প্রতিষ্ঠার লড়াই। এমনকি তন্ময় কোনো দিন সায়মার পছন্দ করে দেওয়া শার্ট পরে অফিসে গেলেও রাগ করে সেদিন না খেয়ে থাকতেন তাঁর মা।

বিষয়টি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল যে বিয়ের এক বছরে নতুন দম্পতি ‘শুধু দুজনে’ কোথাও যেতে পারেননি। দাওয়াতে গিয়ে তন্ময় মুরগির কোন অংশের মাংস খাবে, সেটাও ঠিক করে দিতেন তাঁর মা। পুরো পরিবারে কোথাও সায়মার মতামত প্রকাশের কোনো জায়গা ছিল না।

সেসব দিনের কথা মনে করে সায়মা বললেন, ‘অফিস থেকে ফিরে মনে হতো জেলখানায় ঢুকলাম। দুজন কথা বলতে বসলেও মা এসে পড়তেন। এমনকি সংসারের অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন ধরুন হাতুড়ি-পেরেক, বড় ডেকচি কিংবা সারা মাসের জন্য কেনা চাল-ডালও তিনি রাখতেন আমাদের শোবার ঘরসংলগ্ন কক্ষে। ফলে হয়তো যখন নিজেরা একান্ত সময় কাটাচ্ছি, তখনই কেউ না কেউ এসে ওসবের জন্য দরজায় নক করতেন। আবার ওগুলো যে বের করে অন্য কোথাও রাখব, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও আমার ছিল না।’

অভিভাবকের উচিত তাঁর সন্তানকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে বড় হতে দেওয়া। প্রতীকী ছবির মডেল: মিলি বাশার, ফারজাদ ও ইরানি

শেষ পর্যন্ত নিজেদের সম্পর্ক বাঁচাতে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন এই দম্পতি। প্রথমে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে যান দুজন। এখন সেখানেই স্থায়ী হয়েছেন। শাশুড়ির সঙ্গে সায়মার সম্পর্ক এখন অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। তবে এখনো তিনি সায়মা-তন্ময়ের বাড়িতে এলে নিজের মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সংসারের অভিজ্ঞতায় সায়মাও এরই মধ্যে শিখে নিয়েছেন, কীভাবে সেসব মোকাবিলা করে পথ চলতে হয়।

প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন নিগার সুলতানা (ছদ্মনাম)। তাঁর স্বামী জুলহাস (ছদ্মনাম) পরিবারের একমাত্র সন্তান। ফলে তাঁর জীবনে বাবা-মায়ের বড় একটা প্রভাব ছিল। জুলহাস কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে মিশবেন, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, কোন বিষয়ে পড়বেন, কখন বাসায় ফিরবেন, সবই তাঁরা ঠিক করে দিতেন। জুলহাসও সেই মতোই চলতেন। কিন্তু চাকরি শুরুর পর জুলহাসের জীবনযাপনে পরিবর্তন আসে, বিয়ে করেন। স্বাভাবিকভাবেই নিজে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন। কিন্তু এসব মেনে নিতে পারেননি জুলহাসের মা। তিনি ভাবতে থাকেন, স্ত্রীর কারণে ছেলে বদলে গেছে। নিগার তাঁর ছেলেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, ছেলের জীবনে তাঁর কোনো ভূমিকা আর থাকছে না।

জুলহাস-নিগার কোন দাওয়াতে যাবেন, কোনটায় যাবেন না, সেসব ঠিক করে দেওয়ার প্রবণতা তো ছিলই। নতুন করে শুরু হয় নিগারের জীবনও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। নিগার সেসব মেনে না নিলে শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। আর এসব নিয়ে নিগার-জুলহাসের মধ্যেও শুরু হয় অশান্তি, কথা-কাটাকাটি। একপর্যায়ে বিচ্ছেদের কথা ভাবেন তাঁরা, কিছুদিনের জন্য আলাদা থাকতে শুরু করেন। নিগার বলেন, ‘সে সময় আমাদের বন্ধুরা এসে হাল ধরেছিল। তারা জুলহাস-নিগারকে কাপল কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যান। সমস্যা বুঝতে এবং মোকাবিলা করতে সাহায্য করেন। দুজন মেয়ে বন্ধু জুলহাসের মায়ের সঙ্গেও দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলেছেন, তাকে বুঝিয়েছেন। ফলও মিলেছে।’

নিয়ন্ত্রণ কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনে না। প্রতীকী ছবি

এখন দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছেন এই দম্পতি। জুলহাসের বাবা মারা গেছেন, মা তাঁদের সঙ্গেই থাকেন। এখন বেশ স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁদের দিন কাটছে। তবে জুলহাস-নিগারের মতো সানি-মিতু (ছদ্মনাম) যুগলের শেষটুকু সুন্দর হয়নি। ছয় বছর প্রেমের পর বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বেশি দিন সংসার করতে পারেননি। সমস্যা সেই এক, সানির মায়ের সঙ্গে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তিগত জীবনে বারবার হস্তক্ষেপ মিতু মেনে নিতে পারেননি। সানিও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেননি। ফলাফল বিচ্ছেদ। সানিই বলছিলেন, এখন বিষয়গুলো বুঝতে পারেন তিনি। মায়েরও বয়স হয়েছে, তিনিও নিজের ভুলগুলো ধরতে পারেন। কিন্তু সময়টাই আর তাঁদের হাতে নেই।

কেন এমন হয়

কেন মায়েরা ছেলেদের সংসারে বারবার সমস্যার কারণ হয়ে ওঠেন বা কত দিন পর্যন্ত আসলে ছেলের জীবনে মতামত দেওয়া উচিত, এসব জানতে দ্বারস্থ হয়েছিলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকারের। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘এসব ঘটনার মূল হলো, সন্তানের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া। আসলে নিয়ন্ত্রণ কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনে না। একজন মা বা অভিভাবকের উচিত তাঁর সন্তানকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে বড় হতে দেওয়া। সে যেন স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, সেভাবে তাকে বড় করতে হবে। ১৮ বছরের পর যখন তিনি বাস্তব জীবনে প্রবেশ করবেন, তখন যেন জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারেন, সেভাবে তাকে গড়ে তুলতে হবে।’

জামাইয়ের সঙ্গে মেয়ের সংসার গড়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো মেয়ের মা-ও এই ধরনের অসুবিধা তৈরি করেন। তবে ছেলের মায়েদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি হয় বলে উল্লেখ করলেন মেখলা সরকার। তিনি বলেন, মেয়ের মায়েরা কিন্তু আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন যে মেয়ে বিয়ে করবে, একসময় সে আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু ছেলের মায়েদের এই প্রস্তুতি থাকে না। সব সময়ই তাঁরা ছেলের জীবন নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। সেই নিয়ন্ত্রণ বিয়ের পরও বন্ধ হয় না। সে সময় মায়েরা উল্টো একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। তখন অন্য পরিবার থেকে আসা নতুন সদস্যটি বিব্রত হন, অনেক সময় মেনে নিতে পারেন না। মূলত সেখান থেকেই পরিবারগুলোয় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

বিয়ের পর ছেলে আগের মতো শতভাগ সময় মাকে দিতে পারবে না, এই মানসিক প্রস্তুতি মাকে রাখতে হবে। প্রতীকী ছবি

মায়েরা কী করবেন

এ ক্ষেত্রে মায়েদের প্রতি ডা. মেখলা সরকারের পরামর্শ হলো, নিজের জীবনকে পুরোপুরি সন্তানমুখী করে তুলবেন না। সন্তানকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে, তবে নিজের জীবনের চেয়ে নয়। মায়েরও উচিত নিজের ভালো লাগার কাজে কিছুটা সময় দেওয়া, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সময় কাটানো। বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই ছেলে আগের মতো শতভাগ সময় মাকে দিতে পারবে না, এই মানসিক প্রস্তুতি মাকে রাখতে হবে। ছেলের স্ত্রীকে বহিরাগত না ভেবে পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে ভাবতে হবে। তাকে মনে রাখতে হবে, তিনি ছেলের বউয়ের সঙ্গে যত সুস্থ সম্পর্ক রাখবেন, তাদের দুজনের জীবন তত সহজ হবে। এমনকি তার ছেলের জীবনও তত সমস্যামুক্ত হবে। বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবনের মধ্যে যে কিছু পার্থক্য থাকবে, এটুকু সহজভাবে মাকে মেনে নিতে হবে।

স্ত্রীর করণীয়

আর স্ত্রীদেরও কিছু পরামর্শ দিলেন এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। প্রথমত, শুরুতেই কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখানো। মন খারাপ হলে বা শাশুড়ির কোনো ব্যবহারে বিব্রত হলে প্রথমেই সেটি নিয়ে স্বামীকে অভিযোগ না করা। বরং বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করা। শাশুড়ি যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, সেই সমস্যাটা ধরতে চেষ্টা করতে হবে। মায়ের নামে ছেলের কাছে অভিযোগ না করতেও পরামর্শ দিলেন মেখলা সরকার। তিনি বলেন, স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করতে চাইলে কিছুটা ভিন্নভাবে বলা যেতে পারে। তবে সেটা যেন অভিযোগের মতো না শোনায়। বলা যেতে পারে যে বিষয়টি আমার খারাপ লেগেছে, তবে আমি আসলে মায়ের অবস্থানটাও বোঝার চেষ্টা করছি। কারণ, নতুন সম্পর্কের শুরুতেই স্ত্রীর কাছ থেকে মায়ের বিষয়ে অভিযোগ অনেক ছেলেরই ভালো না–ও লাগতে পারে। তাতে বরং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির সুযোগ থাকে।

ছোটবেলা থেকে যে সন্তানকে কোলেপিঠে মানুষ করেন মা, নিজের অজান্তেই তার প্রতি একধরনের অধিকারবোধ তৈরি হয়। তবে সন্তানের নিজেরও যে একটা জীবন আছে, সেটা মাকে বুঝতে হবে। বিয়ের পরও তাকে নিয়ন্ত্রণ না করে, সঙ্গীর সঙ্গে মন খুলে মিশতে দিন। এতে মা হিসেবে আপনার জায়গাটা যথেষ্ট পোক্তই থাকবে দুজনের কাছে।