সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মোহাম্মদ রেদওয়ানের পরিচয় ‘হৃদয় দ্য সেইলর’। সমুদ্রজীবনের নানা বিষয় নিয়ে ভিডিও তৈরি করেন এই নাবিক। ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকে তাঁর বানানো ভিডিও দেখেন লাখ লাখ মানুষ। তাঁর কনটেন্ট ক্রিয়েটর জীবনের গল্প শুনেছেন সজীব মিয়া
একটু পরেই সূর্য উঠবে। লালচে আকাশ দূরসাগরে মিশে একাকার হয়ে আছে। কেবিন থেকে বাইরে বের হয়ে মনটা ভরে গেল। তিন দিন আগে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে এসেছে এমভি এইচআর সারেরা। জাহাজটির গন্তব্য কলম্বো। জাহাজে ওঠার পর চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে এটা আমার তৃতীয় যাত্রা। প্রায় ১ হাজার ৬০০ কনটেইনার বহনে সক্ষম সারেরা। জাহাজটিতে আমি ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে শেষ এক বছর প্রশিক্ষণকাল কাটিয়েছি। তখনো জাহাজেই কাজ করেছি। এবারই চাকরি নিয়ে জাহাজে ওঠা। তাই দায়িত্বটাও বেশি। নিজের কাজ বুঝে উঠতেই গেছে প্রথম ১৫ দিন। এখন ধীরে ধীরে সবকিছু আয়ত্ত করে ফেলেছি। কেবিন আর ইঞ্জিনরুমের বাইরে বের হওয়ার ফুরসত পাচ্ছি। সমুদ্রের নীল জলরাশির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার অবকাশ মিলছে।
দেখতে দেখতে আকাশে উঁকি দিল সূর্য। মনে হচ্ছিল, সাগরের পেট থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তলাল ডিম। সাগরে সূর্যোদয়ের মতো কিছু অপার্থিব সৌন্দর্যই নাবিকদের একঘেয়ে জীবনে এনে দেয় প্রশান্তি। তখনই বাড়ির কথা মনে পড়ল। কুড়িগ্রামে থাকেন আমার শিক্ষক মা আর আইনজীবী বাবা। তাঁদের মুখ ভেসে উঠল। সকালে উঠে দুজন কী করছেন মনের ছবিতে দেখতে পাই। কথা হলেই তাঁরা আমার সমুদ্রজীবনের নানা কিছু জানতে চান। শুধু মা-বাবার কথাই বলছি কেন, পরিচিত যাঁর সঙ্গেই যখন কথা হয়, সমুদ্রজীবনের গল্প শুনতে চান।
মনে হলো, একটি ভিডিও করে রাখলে সাগরে সূর্যোদয়ের মুহূর্তটা তাঁদের পাঠানো যাবে। মুঠোফোনটা বের করে ভিডিও করি। কলম্বো বন্দরে পৌঁছে সেই ভিডিওটা বাড়িতে পাঠাই। আর আমার ফেসবুক পেজ ‘হৃদয় দ্য সেইলর’-এ শেয়ার করি। এটা গত এপ্রিলের কথা।
সেই শুরু
হালের জাহাজগুলোর মতো এমভি এইচআর সারেরার নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার আগপর্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ফেসবুকে ঢুকতেই চক্ষু চড়কগাছ। ভিডিওটিতে হুহু করে বেড়েছে ভিউ।
অনেকের মন্তব্য, নতুন নতুন ভিডিও চান তাঁরা। জাহাজে জলদস্যু এলে কী করা হয়, ঝড়ের সময় মাঝসমুদ্রে কী অবস্থা হয়, জাহাজে কেউ অসুস্থ হলে বা মারা গেলে কী করা হয়—এমন নানা বিষয়ে মানুষের কৌতূহল। এসব বিষয়ে ভিডিও তৈরি করতে শুরু করি। ফেসবুক পেজে শেয়ার করি।
বেশ কয়েক বছর হলো ইউটিউবে আমার আনাগোনা। তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহ থাকায় এটা নিয়ে ভিডিও বানাতাম। সেগুলো শেয়ারও করতাম। কিন্তু সেটি ছিল অনিয়মিত। তবে কাজটা করতে আমার আনন্দই লাগে। সেই আনন্দই এবার নতুন মাত্রা পায়। ইউটিউবে আমার চ্যানেল ‘হৃদয় দ্য সেইলর’-এ আপলোড করতে থাকি। এখন ‘হৃদয় দ্য সেইলর’ নামেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে পেজ ও চ্যানেল আছে। একই ভিডিও সব মাধ্যমেই শেয়ার করি। ইউটিউব চ্যানেল যেমন (৭ মার্চ পর্যন্ত) ১৩৮টি ভিডিও তুলেছি। আমার এই চ্যানেলে যুক্ত আছেন ১ লাখ ৭১ হাজার সাবস্ক্রাইবার। আর ভিডিওগুলো দেখা হয়েছে ১ কোটি ৮৮ লাখের বেশিবার। ফেসবুক আর টিকটকেও সাত লাখের বেশি মানুষ আমার সঙ্গে যুক্ত।
জাহাজে সারা দিন কী করি
‘জাহাজে সারা দিন কী করি’ শিরোনামেই আমি একটি ভিডিও তৈরি করেছি। দিনভর যা করি, সেসবের গল্পই বলেছি। জাহাজে ছকবাঁধা জীবন। জুনিয়র একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এখন আমার শেখার সময়। ইঞ্জিনরুমে সামান্য ভুলভ্রান্তি হলে ঘটে যেতে পারে বিরাট বিপর্যয়। দুটি পালায়, সকাল ও রাত, সারেরায় আমার ডিউটি। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা আর রাত ৮টা থেকে ১২টা। এর মধ্যে ওভারটাইম করতে হয় বেলা একটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। সকালে যেমন ঘুম থেকে উঠে ক্যানটিনে নাশতা করে ডিউটির জন্য তৈরি হতে হতো। দায়িত্ব বুঝে নিয়ে দেখতে হতো ইঞ্জিন ঠিক আছে কি না, জ্বালানি শোধন করা মেশিনটা ঠিক আছে কি না। কোন ট্যাংকে কত পরিমাণ তেল আছে, ময়লা তেলের পরিমাণ কেমন—এসব হিসাব রাখতে হতো। মেশিনারিজগুলোয় সব সময় খেয়াল রাখতে হতো। কিছু যন্ত্রাংশে প্রতিনিয়ত নজর রাখতে হতো, ঠিকঠাক করতে হতো। জাহাজে সারা দিন কী করি ভিডিওতে এসবই তুলে ধরেছি। এটি ইউটিউবে দেখেছেন ১৩ লাখ মানুষ।
জনপ্রিয় ভিডিওর গল্প
ইউটিউবে আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিওর শিরোনাম ‘জাহাজ থেকে পড়ে গেলে কী হবে’। ভিডিওটি দেখেছেন ১৬ লাখের বেশি মানুষ। অনেকের আগ্রহ দেখে এ বিষয়টি নিয়ে ভিডিও বানিয়েছিলাম। আমি তখন ভারত মহাসাগরে। সাগর ছিল উত্তাল। পুরো জাহাজে ঘুরে ঘুরে ভিডিওটি করি।
অনেকে ভাবেন, সাগরে পড়ে গেলে হয়তো আশপাশে থাকা জাহাজ এসে উদ্ধার করবে বা তীরে গিয়ে উঠব। ভিডিওতে বলেছি, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। যেখানে আছি তার কয়েক শ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে কোনো তীর নেই। দুর্ঘটনাবশত কেউ পড়ে গেলে, প্রথমেই জাহাজে লেগে যেন আহত না হন সেই চেষ্টা করেন। কারণ, জাহাজের প্রপেলার বা পাখা তীব্র গতিতে ঘুরতে থাকে এবং যা অনেক ধারালো। এরপর কোনোভাবে জাহাজে থাকা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। যদিও উত্তাল থাকলে চোখের নিমেষে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে! তাই বলি, সমুদ্র সুন্দর কিন্তু ভয়ংকর সুন্দর। তবে জাহাজে থাকা কেউ তাঁকে দেখলে তাঁদের প্রথম কাজ হলো, লাইফ জ্যাকেট বা অন্য কিছু ফেলে দেওয়া, অন্তত যেন ভেসে থাকতে পারি।
আপনি দেখি ডাঙাতেও নামেন!
জাহাজে আমার ছয় মাস থাকার কথা ছিল। ড্রাইডক কার্যক্রম দেখার কৌতূহল থেকে এক মাস বেশি থেকেছি। ড্রাইডক হলো কয়েক বছর পরপর জাহাজটিকে ডাঙায় তুলে শুকিয়ে ফেলা। জাহাজের নিচের অংশে কোনো ত্রুটি থাকলে সারিয়ে তোলা। এমন একটি কাজের অভিজ্ঞতা পরে কখন পাব না–পাব, ভেবে থেকে যাই। তারপর আবার জাহাজ ভাসিয়ে আমরা চট্টগ্রাম বন্দরে আসি। সেখানে থেকে নিয়ম অনুযায়ী আরেকজনকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে গত অক্টোবরে জাহাজ ত্যাগ করি।
ডাঙায় থাকলেও নতুন নতুন ভিডিও আপলোড করা কিন্তু থেমে থাকেনি। জাহাজের সাত মাসে এত বিষয় নিয়ে ভিডিও করে এনেছি যে আরও ২০টি বিষয়ে ভিডিও তৈরি আছে। তবে দর্শক ভাবেন, আমি জাহাজেই আছি। সেই ভুল অবশ্য ৫ মার্চ ভেঙেছে। দুই বন্ধুর সঙ্গে সেন্ট মার্টিন বেড়াতে গিয়ে তরমুজ খাওয়ার একটি ভিডিও করেছিলাম। সেটি আপলোড করার পরই মানুষের মন্তব্য—‘আপনি দেখি ডাঙাতেও নামেন!’
সত্যিই তাই, জাহাজের জীবন আমাকে আবার ডাকছে। একটি এজেন্সির সঙ্গে আলাপও এগিয়েছে। গত দুই বছর বাড়িতে ঈদ করতে পারিনি। পরিবারের সঙ্গে এবারের ঈদটা কাটিয়েই উঠে পড়ব নতুন কোনো জাহাজে।