জন্ম থেকেই ইমার দুটি চোখ বন্ধ ছিল
জন্ম থেকেই ইমার দুটি চোখ বন্ধ ছিল

জন্মের ১৬ বছর পর আবছা দেখতে শুরু করেছে মেয়েটা

জন্মের পরপরই দেখা গেল মেয়েটির দুটি চোখই বন্ধ। তখনই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু অর্থাভাবে সেই চিকিৎসা তখন খুব বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আবার যখন চিকিৎসা শুরু হলো, তখন মেয়েটার বয়স ১০ বছর। দুজন সহৃদয় মানুষের সহায়তায় গত এপ্রিলে ভারতের শংকর নেত্রালয়ে তার চোখে ষষ্ঠতম অস্ত্রোপচার হয়েছে। চোখে আবছা দেখতে শুরু করেছে সায়মা শারমিন। কাছের মানুষের কাছে ইমা নামে পরিচিত মেয়েটা খুব সুন্দর গান করে। তাকে দেখতে গিয়েছিলেন আবৃতি আহমেদ

একতলা বাসাটা পশ্চিম ধানমন্ডির এক গলির ভেতর। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে পাশাপাশি কয়েকটি কক্ষে। তারই একটিতে ইমারা থাকে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন ইমার বড় বোন। তাঁর সঙ্গে কক্ষের ভেতরে ঢুকে দেখি, চুলে দুই বেণি করে হলুদ জামা পরে বসে আছে ইমা। এক কক্ষের ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে খাট-আলমারি, সেলাই মেশিন ছাড়াও চারজনের পরিবারটার আরও অনেক কিছুই রাখা। এত কিছুর মধ্যেও আলাদা করে চোখে পড়ল সযত্নে ঢেকে রাখা একটা বাক্স। ইমার মা তাসলিমা বেগম বললেন, ‘ইমার হারমোনিয়াম।’ ইমা জানাল, হারমোনিয়ামটাই তার একমাত্র বন্ধু।

গান গাইতে ভালোবাসে ইমা। কয়েক বছর আগে হারমোনিয়ামটা কিনেছে। বাংলাদেশ বেতারের শিশুতোষ অনুষ্ঠান ‘কলকাকলি’–এর সে তালিকাভুক্ত শিল্পী। ছোটবেলায় কখনো বোতলে বোতল ঠুকে, কখনো–বা বিছানার কাঠে আঙুল ঠুকে গানের সুর তৈরি করত। আর কণ্ঠে থাকত রেডিও-টেলিভিশনে শোনা কোনো গানের কলি। জন্ম থেকেই যে শুনে শুনে পৃথিবীকে চিনতে হয়েছে। তবে এখন সে কিছুটা দেখতেও পায়।

‘আমাদের ঘরের ওই জানালাটায় একটা পাখি এসে বসেছিল। অস্পষ্ট হলেও সেটাই আমার দেখা প্রথম পাখি!’ জীবনের স্মরণীয় ঘটনার কথা জানতে চাইলে গালজোড়া হাসি নিয়ে বলল ইমা।

এই স্মরণীয় ঘটনাটা খুব বেশি দিন আগের নয়। গত এপ্রিলে ভারত থেকে চোখের ষষ্ঠতম অস্ত্রোপচার করে দেশে ফেরার পর।

হারমোনিয়ামটাই ইমার একমাত্র বন্ধু

ইমা ভাবত সবাই তারই মতো

ইমার বয়স এখন ১৬ বছর। জন্মের পর দেখা গেল ওর দুই চোখের পাতা জোড়া লাগানো। চোখ খোলে না, একেবারে বন্ধ। ইমার মা-বাবা আর বড় দুই বোন খুব ভেঙে পড়ল। ১০ দিন বয়স, যখন ইমাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসক জানালেন, ভালো চিকিৎসা পেলে ইমা পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে। কিন্তু ইমার যখন দুই বছর বয়স, মারা গেল তার গাড়িচালক বাবা। চারজনের সংসার চালাতেই বেচঈন হয়ে পড়লেন ইমার মা। ইমার চিকিৎসা আর হলো না।

ইমার বড় বোন শিমু আক্তার বর্তমানে স্নাতকোত্তর শেষ করে সংসারের হাল ধরেছেন। মধুবাজার এলাকায় টিউশনি করান তিনি। মেজ বোন সানজিদা শারমিন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। তবে ইমার দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে শিমু ছোটাছুটি করেছেন প্রতিনিয়ত। তিনি বলছিলেন, ‘আমার ছোট্ট বোনটি জানতই না যে সে অন্ধ। ভাবত, ও আমাদের মতোই একজন। যখন কিছুটা বুঝতে পারল, তখন একদিন এক হাতে নিজের চোখ এবং অন্য হাতে আমার চোখ ধরে বুঝতে চেষ্টা করল পার্থক্যটা কোথায়; হয়তো তখনই বুঝেছিল যে আর দশজনের থেকে সে আলাদা।’

সত্যিই ইমা আলাদা! কেননা, তার গলায় যেমন সুর আছে, তেমনি মনে আছে লড়াই করার জোর।

সুরের ধারায় স্বপ্ন দেখা

ছোট থেকেই ইমার গানের গলা বেশ। ২০১৫ সালে বোনদের হাত ধরে ‘খুদে গানরাজ’ প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছিল। সেই আসরে বাছাইয়ের প্রথম পর্বে টিকে গেলেও পরের পর্বে আর অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। এখনো সেই কথা মনে করে ভীষণ মন খারাপ করে ইমা, ‘ভেবেছিলাম সব শেষ। গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। এভাবে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল।’

লালমাটিয়ার সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’য় কাজ করেন ইমার এক মামা। তিনিই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও সুরের ধারার চেয়ারম্যান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ইমার কথা জানান। ইমাকে একদিন ডেকে পাঠান বন্যা। ইমার গান শোনেন বরেণ্য এই শিল্পী। নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করে ইমা, ‘বন্যা ম্যাম আমার গান শুনলেন; আমার কণ্ঠের প্রশংসা করে আরও চর্চা করতে বললেন। সে থেকে আমি সুরের ধারার ছাত্রী।’

সুরের ধারার মিউজিক ফর ডেভেলপমেন্ট সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। এই কর্মসূচির অংশ হয়েই বিনা বেতনে গান শিখছে ইমা। ইমার মিষ্টি কণ্ঠের প্রশংসা করে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলছিলেন, ‘গানের প্রতি প্রবল আগ্রহ মেয়েটির, কিন্তু গায়িকা হওয়া তো সাধনার বিষয়। তাই আমরা তাকে সেই জায়গাটুকু করে দিতে চেয়েছি, যেন সে গান শিখে ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারে।’

‘ইমা আমার মেয়ের মতো’

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা শুনেছিলেন চিকিৎসা করাতে পারলে ইমার চোখে আলো ফোটার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ জন্য দরকার অর্থ। সুরের ধারার মিউজিক ফর ডেভেলপমেন্টে আগে থেকেই সহায়তা করছিল সামিট গ্রুপএকদিন ইমাকে সঙ্গে করে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের কাছে গেলেন বন্যা। বললেন, ‘মেয়েটি দেখতে পায় না, কিন্তু গানের গলা বেশ ভালো।’

আজিজ খান তার গান শুনতে চাইলে ইমা গাইতে শুরু করে, ‘বড় সাধ জাগে, একবার তোমায় দেখি, কতকাল দেখিনি তোমায়।’ গান শুনে কেঁদে ফেলেন আজিজ খান, গানটি হয়তো প্রেমের গান কিন্তু একটি অন্ধ মেয়ের কণ্ঠে এই গান অন্য রকম লাগছিল। সেই থেকে মেয়েটির চিকিৎসার বিষয়টি দেখভাল করছেন আজিজ খান।

সামিট গ্রুপের আর্থিক সহায়তায় ভারতের চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে শুরু হয় ইমার চোখের চিকিৎসা। গত এপ্রিলে ষষ্ঠবারের মতো অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও কয়েকবার হবে। এবার অস্ত্রোপচার কক্ষে চিকিৎসকদের লতা মঙ্গেশকরের গান ‘লাগ যা গালে’ গেয়ে শুনিয়েছে ইমা। সেই গানের ভিডিও ফেসবুক প্রোফাইলে শেয়ার করেছেন মুহাম্মদ আজিজ খান। তিনি বলেন, ‘ইমা আমার মেয়ের মতো, ওর প্রতি আমি অন্য রকম দায়িত্ব বোধ করি। আমি চাই, ইমা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে, পড়াশোনা করবে, ওর যে বড় গায়িকা হওয়ার প্রত্যয়, সেই স্বপ্ন পূরণে আমরা সাহায্য করে যাব।’

ইমা স্কুলে যাবে

ইমার কথা বলার ধরন আর শব্দচয়ন স্পষ্ট ও সাবলীল। এতক্ষণ কথা বলেও বুঝতে পারিনি কোনো দিন সে স্কুলেই যায়নি। ‘যে ধরনের স্কুল ওর দরকার, সেই স্কুল অনেক দূরে; যাতায়াতের অসুবিধার জন্য চাইলেও নিতে পারি না। যতটুকু শিখেছে ওর বোনদের কাছেই শিখেছে’, কথাটুকু বলে চোখ মুছলেন ইমার মা। আর ইমা বলল, ‘চোখ ভালো হলেই আমি পড়াশোনা করব।’

একটু বিরতি নিয়ে আবার বলল ইমা, ‘চোখ ভালো হয়ে গেলে আমি অবশ্যই স্কুলে যাব। আমার ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার। আর গান তো আমার চিরসঙ্গী।’

গল্প শেষ হলে ইমাকে বললাম, ‘তোমার কয়েকটা ছবি তুলব, হাসলে সুন্দর দেখাবে।’

ক্যামেরা তাক করে অবাক হয়ে দেখি, মেয়েটি চেষ্টা করেও মেকি হাসি হাসতে পারছে না। পারবে কী করে, সে যে মনের চোখে দেখে, খাঁটি অনুভবে হাসে।