বর্ষা মানেই স্মৃতির উৎসব

বর্ষার গান আছে, কবিতা আছে। পোশাকও আছে। এলোকেশে থাকে কদমফুল। বর্ষায় আছে ভ্রমণও। আর আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার, খিচুড়ি।

বাংলায় সবচেয়ে নন্দিত-বন্দিত ঋতু কোনটা? অবশ্যই বর্ষা। এটা বলার জন্য গালে হাত দিয়ে বসতে হয় না। বসন্ত নয়, কাব্যপ্রেমী বাঙালির প্রিয় ঋতু বর্ষা। কেন এ-রকম হলো! কেন বর্ষা নিয়েই হাজার হাজার গান, কবিতা, ছবি, চলচ্চিত্রের দৃশ্য! এবং এই চলতি ধারা বা ট্রেন্ড আজকের নয়, হাজার বছর আগে থেকেই বাঙালির জীবনে সবচেয়ে ট্রেন্ডি ঋতু বর্ষা।

বাংলাদেশ সবচেয়ে সুন্দর বর্ষাকালে

এর একটা কারণ বোধ হয়, বাংলাদেশ ছিল জলমগ্ন একটা দেশ। বর্ষাকালে ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমাদের পূর্বপুরুষদের। কাজেই তাঁরা গান রচনা করতেন, গাইতেন, শিল্পের চর্চা করতেন বর্ষাতেই। বর্ষা এমন একটা ঋতু, যা পঞ্চইন্দ্রিয়কে কেবল নাড়া দেয় না, জীবনকে নাড়িয়ে দেয়। বসন্তকাল আমাদের দেশে আলাদা তাৎপর্য আনে না; কারণ, শীতের দেশের মতো এখানে তুষারপাত হয় না, গাছের পাতা ঝরে পড়ে সব ন্যাড়া হয়ে যায় না; ওসব দেশে বসন্ত আনে মুক্তির বার্তা, গেয়ে ওঠে জীবনের ও যৌবনের গান। আমাদের শীত অত প্রকট নয়, তুষার ঝরে না এখানে, কাজেই বসন্ত আলাদা করে বোঝাই যায় না। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমাদের এই চোখ-পোড়ানো আলোর দেশে বর্ষার আকাশ আমাদের চোখে কী যে অপূর্ব স্নিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে দেয় তা বাঙালি মাত্রেই জানে। আজকের আকাশ দেখে মনে হয়, ছায়ার রঙের কোনো পাখির পালক দিয়ে বর্ষা তাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে দিয়েছে, তাই তার স্পর্শ আমাদের চোখের কাছে এত নরম, এত মোলায়েম।’

বাংলাদেশ সবচেয়ে সুন্দর বর্ষাকালে। গাছের পাতা ঘন সবুজ। আউশের খেত জলে ভরভর। এক রত্তি ধূলি নেই গাছের পাতায় পাতায়। অন্য ঋতুগুলোয় গাছের পাতা সব ধূসর, ধূলিমলিন।

এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাধাকৃষ্ণের কিংবদন্তি। কৃষ্ণ যমুনা নদীর তীরে কদম্বতলে বাঁশি বাজাচ্ছেন, নীল শাড়ি পরে রাধা চলেছেন অভিসারে। বর্ষা এলে তাই বাঙালির হৃদয় চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমাদের সমন্বিত অবচেতনে কালিদাসের মেঘদূত ছায়া ফেলে। রবীন্দ্রনাথ কত যে বর্ষার গান লিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামও মুখর বর্ষাবন্দনায়। এমনকি হুমায়ূন আহমেদও বৃষ্টিবিলাস করেছেন সুপ্রচুর: যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়। যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী, কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।

চারদিকে থাকে সবুজের সমারোহ

বর্ষা তাই নাগরিকদের উদ্‌যাপনের বিষয় হয়ে উঠেছে। আকাশে মেঘ, আজ বোধ হয় বৃষ্টি হবে, ও গো, একটু খিচুড়ি চড়িয়ে দাও না। এই বায়না ঘরে ঘরে। কেন বৃষ্টিদিনেই খিচুড়ি খেতে হবে? বোধ হয় খিচুড়ি খেলে পিপাসা বেশি পায়, শুকনো দিনে না খেয়ে আর্দ্র দিবসে খেলে কম তেষ্টা পাবে, সেটা একটা কারণ। নাকি গ্রামে গ্রামে চুলা ছিল উঠানে, বৃষ্টি দিনে খড়িও যেত ভিজে, তখন সবচেয়ে সহজ রান্নাটা করাই ছিল বুদ্ধিমত্তার কাজ, ডাল আর চাল হাঁড়িতে বসিয়ে দিলেই হয়ে গেল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার, খিচুড়ি। সঙ্গে ডিম ভাজা হলে তো কথাই নেই। আর আজকাল যুক্ত হয়েছে ইলিশ ভাজা। উমম।

বর্ষার গান আছে, কবিতা আছে। পোশাকও আছে। নীল শাড়ি, মেঘবরণ পাঞ্জাবি। এলোকেশে একটা কদমফুল। বর্ষায় আছে ভ্রমণও। চলো মন ভাটি অঞ্চলে, লঞ্চে করে বৃষ্টি দেখব। কিংবা বৃষ্টিদিনে বসে থাকব সমুদ্রের ধারে।

আমাদের ছোটবেলায় বর্ষায় আমরা বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলতাম, মাঠে জমে থাকা পানিতে পুকুর থেকে উঠে আসা মাছ কিলবিল করত, ডারকি পেতে মাছ ধরতাম। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে খালের পানিতে লগি ঠেলতাম। উঠানজুড়ে আমের খোসা, কাঁঠালের ভুতি, বাতাসে ফলের তীব্র গন্ধ আর নীল মাছির ভনভন। আরেকটা জিনিস ছিল। তিলা। সাদা শার্টে কালো কালো দাগ পড়ত, আমরা বলতাম, তিলা। এখনো কি পড়ে? এখনো কি রেইনি ডে হয় স্কুলে? পাওয়া যায় ডাবল টিফিন? পলিথিনের ব্যাগে বই ভরে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে ছাতা মাথায় চলেছি স্কুল; অন্যদিন যাই বা না যাই, বৃষ্টিদিনে যেতেই হবে। বৃষ্টি ছাতায় মানত না, ভিজে যেতামই।

এ সময় ঘুরতে পছন্দ করেন অনেকেই

তারপর তিন দিন জ্বর। ভয়াবহ ব্যাপার। ভাত বন্ধ, সাগু বা বার্লি খেতে হবে। আম্মা মাথায় পানি ঢালছেন, আর বকবক করছেন, যাও, পুকুর তোমাকে ডাকছে, যাও, ঝাঁপাল পাড়ো। সন্ধ্যা নামছে, আকাশ অন্ধকার। কার মেয়ে ডেকে উঠছে: আয় আয় হাঁসগুলো তই তই তই...ফিরে এসো হে শৈশব আমার। এমন দিনেই তারে বলা যায়। এমন ঘনঘোর বরিষায়।

আর কিছু না পারি, ফেসবুকের স্ট্যাটাসে তো একটুখানি কাব্য করতে পারি! জল পড়ে, পাতা নড়ে, বন্ধুর কথা, মনে পড়ে।

আমার আম্মার কথা মনে পড়ে, আব্বার কথা মনে পড়ে, সেই টিনে ছাওয়া ঘর, শজনে ডাল, আম্মার হাতে বানানো মোটা চালের নরম খিচুড়ি...স্লুইসগেট খুলে দেওয়া ঘাঘটের ঢল, শ্যামাসুন্দরী খাল উপচে আমাদের কটকিপাড়ার বাসার উঠানের কোণে...