একবার না পারিলে দেখো তিনবার

সোমা গোস্বামীর জন্মের বেশ কয়েক বছর পর তাঁর ছোট ভাইয়ের জন্ম। মাঝখানের এই সময়টায় পাড়ার লোকেদের এক ভিন্ন রূপ দেখেছেন সোমা। অনেকে তাঁর বাবাকে বলত, ‘তোমার তো ছেলে নেই, মারা গেলে মুখাগ্নি করবে কে?’ সোমার বাবা অবশ্য কথাটা শুনে মন খারাপ করতেন না। বরং বড় মুখ করেই বলতেন, ‘আমার মেয়েই আমার মুখে আগুন দেবে।’

আলীনগর চা–বাগান এলাকায় সোমা গোস্বামীদের বাড়ি। এটি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার অন্যতম চা–বাগান। তাঁর বাবা চা-শ্রমিক। সোমারা চা–বাগানের যে পাড়ায় বড় হয়েছেন, সেখানে মেয়েদের ঘরবন্দীই থাকতে হয়। তিনি বড় হওয়ার দিনগুলোতে দেখেছেন, ছেলেরা স্বাচ্ছন্দ্যে খেলাধুলা করছে আর মেয়েদের ক্ষেত্রে কোথায় যেন অলিখিত এক বাধানিষেধ।

তবে বাবাকে বরাবরই পাশে পেয়েছেন সোমা। তাই তো অন্য শ্রমিকের সন্তানেরা যখন চা–বাগানের স্কুলে ভর্তি হয়, সোমাকে শহরের স্কুলে ভর্তি করেন তাঁর বাবা। যেন বাইরের পরিবেশে আরও ভালো কিছু শিখতে পারে মেয়ে।

অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি নিয়ে পাস করার পর সোমা অনুভব করলেন, নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করার যে খরচ, তাঁর পরিবারের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। এ সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর শিক্ষক ও সহপাঠীরা। সোমা বলেন, ‘সব সময় আমি সকলের সহযোগিতা পেয়েছি। আমার শিক্ষকেরা স্বল্প সম্মানীতে আমাকে পড়িয়েছেন। সহপাঠীরা গাইড দিয়ে সাহায্য করেছে। সকলের সহায়তায় আমি এসএসসি পাস করি।’

সোমা গোস্বামী

এসএসসি উপবৃত্তির তালিকায় নাম না থাকায় সোমা ভেবেছিলেন কলেজে পড়া বুঝি আর হলো না। তখনই এগিয়ে আসেন স্থানীয় এক সাংবাদিক। কলেজের বেতন দিয়ে সোমাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়ই টিউশনি শুরু করেন সোমা। সামান্য সেই টাকা দিয়ে নিজের পড়াশোনার বাকি খরচ মেটানোর চেষ্টা করেছেন।

কলেজে পড়ার সময় এক সহপাঠীর কাছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগের কথা শোনেন সোমা। এইচএসসি পরীক্ষার পর এইউডব্লিউতে ভর্তি পরীক্ষাও দেন সোমা। কিন্তু ভাইভা ভালো না হওয়ায় সেবার আর সুযোগ হয়নি। মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজে বাংলা বিষয়ে ভর্তি হয়ে আবারও এইউডব্লিউতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সোমা বলেন, ‘দ্বিতীয়বারও ভর্তি হতে পারিনি। বিষয়টা মেনে নিতে পারছিলাম না। আর চারপাশের মানুষেরা হাসি-তামাশাও শুরু করে। এতে জেদ চেপে যায়। তৃতীয়বারের মতো পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। কিন্তু কাউকে জানালাম না যে আমি পরীক্ষা দেব, এমনকি বাসাতেও না।’

তৃতীয়বারের চেষ্টায় যে কেবল ভর্তিরই সুযোগ পেলেন তা নয়, সেই সঙ্গে ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তিও পেলেন সোমা। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দ্য ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি চালু করে। অসচ্ছল পরিবারের প্রথম নারী, উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে যিনি সমাজ গঠনে আগ্রহী, এ রকম ১০ জনকে প্রতিবছর এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এ বৃত্তি পেয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে এ শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয় আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড। নতুনভাবে নাম হয় ‘অদ্বিতীয়া’। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৩৬ জনসহ এ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এ বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।

করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের নানা ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে অবশেষে ক্যাম্পাসে ফিরেছে সোমা ও তাঁর সঙ্গে সুযোগ পাওয়া আরও ৯ অদ্বিতীয়া। সোমা বলেন, ‘আমার জীবনের লক্ষ্য দুটি। আমার মা–বাবার বয়স হয়েছে, তাদের সুন্দর জীবন দিতে চাই আর আমার ছোট ভাই–বোনদের পড়াশোনা দায়িত্ব নিতে চাই। পরিবারের পাশাপাশি আমার সম্প্রদায়ের জন্যও কাজ করতে চাই।’