সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শ্রাদ্ধকৃত্য ‘ভান্ডান’। এ আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের একটি অংশে থাকে ‘ডানটা দন’। এটি মূলত নৃত্যগীতের মাধ্যমে শোক প্রকাশ। কিন্তু আচমকা কেউ দেখলে মনে করবে, এ বুঝি আনন্দ আয়োজন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রয়াত সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের ডানটা দন দেখে এলেন আনোয়ার হোসেন
সাঁওতালদের বিভিন্ন পালাপার্বণে নাচগান দেখেছি। সেসব দেখে আনন্দও পেয়েছি। কিন্তু ‘ভান্ডান’ (শ্রাদ্ধানুষ্ঠান) আগে কখনো দেখিনি। সেই আয়োজনেও যে নাচগান থাকতে পারে, ভাবিনি। তাই প্রথমবার দেখে বিস্মিত হয়ে ভেবেছি—এ কেমন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান! পরে মনে হয়েছে, প্রকৃতির সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকা সাঁওতালি সংস্কৃতি কতই না বৈচিত্র্য-বৈভবে ভরা।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন ছিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাতে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নিজের বাড়িতে তিনি মারা যান। বারকোনা গ্রামে তাঁর ভান্ডান হয় গত ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি। সাঁওতালি রীতিতে মৃত্যুর ৭ থেকে ১৫ দিন পরে হয় ভান্ডান বা শ্রাদ্ধকৃত্য। ভান্ডানের আগে মৃতের সন্তান ও পরিবার ছুঁত বা অশৌচ পালন করে, মাছ-মাংস–আমিষ খাবার গ্রহণ করে না। অশৌচ পালনের সময় চুল, নখ কাটা যায় না। গান্ড (কাঠের পিঁড়ি) এবং পরকুমে (খাটিয়া) বসা যায় না। তেল-সাবান মাখা যায় না। ভান্ডান মূলত দুই দিনের অনুষ্ঠান। থাকে নানা পর্ব। যার একটি ‘ডানটা দন’। এই পর্বে ‘রিনঝে’ নামের একটি দল বিশেষ নাচের সঙ্গে গান পরিবেশন করে।
মাদল-নাগরা বাজিয়ে নেচে-গেয়ে রবীন্দ্রনাথ সরেনের বাড়ির উঠোনে ঢোকে রিনঝে দল। আগে থেকে উঠোনের মধ্যখানে পুঁতে রাখা কারাম ডাল ও টুলের ওপর রাখা রবীন্দ্রনাথ সরেনের ফুলের মালা পরানো ছবির চারদিকে গোল হয়ে ঘুরে নেচে গাইতে থাকে শোকের গান। গানে মিশে থাকে বিষাদের সুর। একটি গানের মর্মার্থ এমন, ‘একদিন বাবা ছিল। অনেক শস্য উৎপাদন হতো। বাড়িতে অনেক অতিথি আসতেন। তাদের অনেক আপ্যায়ন করতাম। সম্মান করতাম। আজ বাবা নেই। আমরা কি আর অতিথিদের আগের মতো সম্মান করতে পারব? হায়! হায়! আজ আমরা কোথায় যাব...’
এক দিকে ধূপের ধোঁয়ার গন্ধ, অন্যদিকে কারাম ডালের পূজা। পাশাপাশি শোকগীতি। সৃষ্টি হয় এক বেদনাবিধুর পরিবেশ। দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে এসব। এরপর উঠান থেকে কারাম ডাল তুলে দুই হাতে ধরে কাঁধে নেয় রবীন্দ্রনাথ সরেনের ছেলে মানিক সরেন। আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটি পুকুরে দিকে এগিয়ে যায়। পেছনে পেছনে নেচে-গেয়ে এগিয়ে চলে রিনঝে দল। মনে হয় যেন একটা এক শোকমিছিল। একজনকে সঙ্গে নিয়ে কারাম ডাল বিসর্জন দিতে পুকুরে নামে মানিক। পুকুরপাড়ে গোল হয়ে চলতে থাকে রিনঝে দলের ডানটা দন। একডুবে কারাম ডাল বিসর্জন দেওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভান্ডানের আনুষ্ঠানিকতা।
সাঁওতালদের বিশ্বাস, এরপর পরপারে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে স্বর্গে বসবাস করতে পারবে মৃতের আত্মা।