বিলেত থেকে কি ‘সুখবর’ আসবে

গণিতদলের ৬ সদস্য
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘বাংলাদেশের পতাকার রংটা আমার খুব পছন্দের। আর আমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে গণিত। প্রিয় রঙের টি–শার্ট পরে, প্রিয় বিষয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করব, ভেবে ভালো লাগছে,’ বলছিল মনামী জামান। বাংলাদেশ গণিত দলের ছয় সদস্যের মধ্যে সে একজন। বাকিরা হলো এস এম এ নাহিয়ান, জিতেন্দ্র বড়ুয়া, তাহসিন খান, মো. নাফিজ নূর ও মুসাহিদ আহমদ। আজ ভোরে তারা ৬৫তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে রওনা হয়ে গেছে। ১৫ জুলাই ইংল্যান্ডের বাথ শহরে বসছে এবারের আসর। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশের প্রায় ৬০০ প্রতিযোগী অংশ নেবে সেখানে।

রাজধানীর লালমাটিয়ায় বাংলাদেশ গণিত দলের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল প্রস্তুতিমূলক ক্যাম্প। ক্যাম্পে বসেই আলাপ হয় খুদে গণিতবিদদের সঙ্গে।

ভালো করার প্রস্তুতি

চট্টগ্রাম বাকলিয়া সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র জিতেন্দ্র বড়ুয়া গতবারের আয়োজনে ১৬ নম্বরসহ ‘সম্মানজনক স্বীকৃতি’ পেয়েছিল। বলল, ‘এবারের ক্যাম্পে আমি ৫ ও ৬ নম্বর প্রশ্ন নিয়ে বেশি সময় দিচ্ছি। নিজের ব্যক্তিগত স্কোর আরও ভালো করতে চাই। গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো নম্বর ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। সেটাও মাথায় আছে।’

ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র তাহসিন খানের বক্তব্য, ‘আমি দলে নতুন। ক্যাম্পে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটার পর একটা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়।’

যুক্তরাজ্যের পথে রওনা হয়ে গেছে এই দল

পরীক্ষার মধ্যে আরেক পরীক্ষা

২০২৩ সালের আইএমওতে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন এস এম এ নাহিয়ান। ঢাকা কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন তিনি। তবে গণিত দলের এই সদস্য আইএমওতে অংশগ্রহণের সুযোগও হাতছাড়া করতে চাননি। বললেন, ‘উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যেই অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিতে একটু কষ্ট করতে হচ্ছে। দেখা গেছে একটা পরীক্ষা শেষ করেই আমি চলে এসেছি ক্যাম্পে। ১৪ তারিখেও একটা পরীক্ষা শেষ করে ইংল্যান্ডের প্লেন ধরতে হবে। দুই দিনের অলিম্পিয়াড শেষ করে সমাপনী অনুষ্ঠান না করেই আবার আমাকে দেশে ফিরতে হবে। গতবার ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম ২৪ নম্বর পেয়ে, এবারে নিজের স্কোর আরও বাড়াব।’

ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মো. নাফিজ নূরও ভালো নম্বরের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

প্রথমবার বিমানে

মুসাহিদ আহমদ পড়ে বরিশাল ক্যাডেট কলেজে। সেই সুবাদে নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকে পড়ালেখার চর্চা তার আগে থেকেই ছিল। অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতিও মুসাহিদ নিয়েছে রুটিন মেনে। একাদশ শ্রেণির এই ছাত্রের বক্তব্য, ‘বাংলাদেশের সব ক্যাডেট কলেজগুলোর মধ্যে থেকে আমি প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডের আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছি। নাম্বার থিওরি আর জ্যামিতি নিয়ে ক্যাম্পে অনেক প্রস্তুতি নিয়েছি। আগের বছরের প্রশ্ন সমাধানের পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখার কৌশলগুলো গণিত দলের কোচ মাহবুব মজুমদার স্যারের কাছ থেকে শিখেছি। আমার গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও। আগে কখনো বিমানে চড়িনি। প্রথমবার বিমানে চড়েই ইংল্যান্ড যাচ্ছি। এটাও খুব মজা লাগছে।’

দলের একমাত্র নারী সদস্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনামী জামান। মনামী আগেও নানা আয়োজনে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হাজির হয়েছে। বলল, ‘আশা করছি ইংল্যান্ডে চমক দিতে পারব।’

দেশসেরারা যাচ্ছে বিশ্বমঞ্চে

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যেন গণিতকে ভয় না পেয়ে বরং এর মজাটা সাদরে গ্রহণ করতে পারে, সে লক্ষ্যেই প্রতিবছর প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব’। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি দেশব্যাপী গণিত উৎসব আয়োজন করে। এবারের ২২তম আয়োজনে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের মূল দলে জায়গা করে নিতে লড়েছিল সারা দেশের প্রায় ৭১ হাজার শিক্ষার্থী। অনলাইনে প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার পর উত্তীর্ণদের নিয়ে ১৮টি শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা। সেখান থেকে ১ হাজার ৩৫০ জন আঞ্চলিক বিজয়ীকে নিয়ে ঢাকায় হয়েছে জাতীয় উৎসব। বিজয়ী ৮৫ জনকে নিয়ে বাছাই পরীক্ষার পর উত্তীর্ণ ৪০ জনকে নিয়ে শুরু হয় গণিত অলিম্পিয়াড ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে ধাপে ধাপে এশিয়ান-প্যাসিফিক গণিত অলিম্পিয়াড ও আইএমও নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সেরা ছয়জনকে নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াডের মূল দল গঠন করা হয়েছে।

আইএমও নিয়ম অনুসারে একটি দেশ থেকে সর্বোচ্চ ছয়জন চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। গত ১৯ বছরে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা জিতেছে ১টি স্বর্ণ, ৭টি রৌপ্য, ৩৫টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৪৩টি পদক এবং আরও ৪০টি সম্মাননা স্বীকৃতি।