৫ আগস্ট–পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে মুঠোফোনে ‘খুলনা কন্ট্রোল’ নামে একটা প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে অ্যামেচার রেডিও ক্লাব খুলনা। তাতে যুক্ত হয়েছেন কয়েক শ তরুণ স্বেচ্ছাসেবী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, উদ্ধার কার্যক্রম, জরুরি রক্ত জোগাড়, খাবার ও পানীয় সরবরাহসহ বিভিন্ন কাজ নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন তাঁরা। প্ল্যাটফর্মটির আরও গল্প শোনাচ্ছেন উত্তম মণ্ডল
জেলো নামের অ্যাপে লগইন করে ‘খুলনা কন্ট্রোল’–এ ঢুকতেই মুঠোফোনটা ওয়াকিটকি হয়ে গেল! ঘরে বসেই জানতে পাচ্ছিলাম খুলনা মহানগরীর হালচাল। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে একেক দল স্বেচ্ছাসেবী একেক তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ সমস্যার কথা বলছেন, কেউ নিজেদের কাজের তথ্য দিচ্ছেন, কেউ চাচ্ছেন কাছাকাছি থাকা অন্য দলের সহায়তা। বাসায় বসেই এসব শুনছি। একজন বলে উঠলেন, ‘হ্যালো খুলনা কন্ট্রোল, সোনাডাঙ্গা মেট্রোপলিটন কলেজ রোডে তিনজনকে আটক করেছেন জনতা। গণধোলাই দিচ্ছেন। উদ্ধার করে থানায় দেওয়া দরকার। রেসকিউ টিম পাঠান।’
অন্য প্রান্ত থেকে একজন বলে ওঠেন, ‘ঠিক আছে আমরা কয়েকটা দল যাচ্ছি।’
কিছুক্ষণ পর আবার মুঠোফোনে বার্তা, ‘এখন কী অবস্থা।’
এ প্রাপ্ত থেকে আপডেট, ‘হ্যাঁ, তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে।’
এই ঘটনার সুরাহা হতেই খুলনার ময়ূরী আবাসিক এলাকায় এসে থমকে দাঁড়ান স্বেচ্ছাসেবীদের একটি দল। একটি বাড়ির ফটকে কারা যেন তালা ভাঙছেন। লোকগুলো কি ভেতরে ঢুকে সব লুট করবেন? প্রশ্নটা মাথায় উঁকি
দিতেই মুঠোফোন হাতে নেন দলের একজন। অ্যাপে ঢুকে বলেন, ‘খুলনা কন্ট্রোল, ময়ূরী আবাসিক এলাকার পাশে একটা বাড়ির গেটের তালা ভেঙে কারা যেন ভেতরে ঢুকেছেন। আমাদের আরও টিম দরকার।’
শিববাড়ি থেকে একজন বলে ওঠেন, ‘ঠিক আছে আপনারা একত্রিত হয়ে দেখেন, আমরা শিববাড়ি থেকে আসছি।’
আরেকটি দল থেকে জানানো হয়, ‘আমরা মেডিকেল কলেজ মোড় থেকে আসছি। আর নৌবাহিনীর একটা টহল গাড়ি সোনাডাঙ্গার কাছাকাছি আছে। নাম্বার ম্যাসেজ করেছি যোগাযোগ করেন, ফোন দেন।’
ময়ূরী আবাসিক এলাকার পাশে থাকা টিম কিছুক্ষণ পর জানায়, ‘এখন ক্লিয়ার…বাড়ির লোকজনই চাবি হারিয়ে যাওয়ায় তালা ভেঙে গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়েছেন, বাড়ির মালিক বলছেন সমস্যা নেই।’
১৪ আগস্ট রাতভর এভাবে কথোপকথন চলতে থাকে। খুলনা নগরকে নিরাপদ রাখতে দিনের মতো রাতেও জেগে পাহারা দিতে থাকেন বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, স্কাউটস, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি-খুলনা সিটি ইউনিট, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের মানুষও ‘খুলনা কন্ট্রোল’ প্ল্যাটফর্মে যোগ দিয়েছেন। ব্যবহারকারীরা একজন হয়তো অন্যজনকে চেনেন না, তবে কাজের ক্ষেত্রে সেটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবীরা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, দিন ও রাতের টহল, উদ্ধার কার্যক্রম, রক্ত জোগাড়, মাদক উদ্ধার, চোর ও অন্য দুষ্কৃতদের আটকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর, খাবার ও পানীয় সরবরাহসহ বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন।
খুলনার অ্যামেচার রেডিও ক্লাবের প্রধান কার্যালয় কেডিএ অ্যাভিনিউ এলাকায়। ৮ আগস্ট সেখানে বসেছিলেন ক্লাবের সদস্যরা। অ্যামেচার রেডিও একধরনের শখ। বিশেষ ধরনের রেডিওর মাধ্যমে দূর দেশের আরেক রেডিও গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা। দুর্যোগকালে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগব্যবস্থা যখন ব্যাহত হয়, এগিয়ে আসেন অ্যামেচার রেডিওর স্বেচ্ছাসেবকেরা। ৫ আগস্ট দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়লে দায়িত্ববোধ থেকেই একত্রিত হয়েছিলেন খুলনার অ্যামেচার রেডিওর সদস্যরা। কীভাবে তাঁরা কাজ করতে পারেন, সেই লক্ষ্য নিয়েই শুরু হয় আলাপ।
সেখানে ক্লাবের সহসভাপতি ও তরুণ আইটি উদ্যোক্তা আশরাফুল হক ভার্চ্যুয়াল ওয়াকিটকি অ্যাপ জেলো ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। যেকোনো স্মার্টফোনকে ওয়াকিটকিতে পরিণত করতে পারে এই অ্যাপ। একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলে একই সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারেন কয়েক হাজার মানুষ। কেউ কথা বললে লিসেনারের ডিসপ্লেতে ভেসে ওঠে তাঁর নাম, ইউজার আইডি, ছবি। একজন কথা বলার সময় অন্য ব্যবহারকারী বলতে পারেন না বলে একই সঙ্গে অনেকে কথা বলার মতো বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় না। কথার মাধ্যমে যোগাযোগের পাশাপাশি বার্তা, ছবি শেয়ার ও লোকেশন শেয়ারের মতো সুবিধাও পাওয়া যায়।
আশরাফুল হক বলছিলেন, ইন্টারনেট ব্লাকআউটের সময় বুঝতে পারি মানুষে মানুষে যোগাযোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাপক হারে খারাপের দিকে যেতে থাকে। পুলিশ না থাকায় মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে রাস্তায় টহলে বের হন। আমরা ঘুরেফিরে দেখলাম, তাঁদের মধ্যে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো সাধারণ প্ল্যাটফর্ম। সবকিছু যেন বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে। যোগাযোগ নিয়ে আমাদের যেহেতু ধারণা ও কিছুটা দক্ষতা আছে, তাই আইনের মধ্যে থেকে কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই জেলো অ্যাপে কাজ শুরু করি।
ক্লাবের সদস্যরা জেলো অ্যাপে একটি চ্যানেল খুলে নাম দেন ‘খুলনা কন্ট্রোল’। চ্যানেল খোলার পর অ্যামেচার রেডিও ক্লাবের পক্ষ থেকে পথে পথে দিনে ও রাতে যাঁরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে এটি ছড়ানো শুরু করে। কীভাবে অ্যাপটি ইনস্টল করতে হবে, কীভাবে এটা কাজ করবে, এসব নির্দেশনা–সংবলিত একটা লিফলেটও সব এলাকার টহল টিমগুলোর কাছে দেওয়া হয়। এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জার গ্রুপের ছাড়িয়ে এখন এটা হয়ে উঠেছে পুরো খুলনার অন্যতম যোগাযোগমাধ্যম।
একাধিক অ্যাডমিন ও মডারেটর এখন সার্বক্ষণিক চ্যানেলের কার্যক্রম নজরে রাখছেন। চ্যানেলে থাকা কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা করতে গেলে অ্যাডমিন ও মডারেটর তাঁকে মিউট, সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করছেন। কোনো কথা পরে গুজব হিসেবে প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
খুলনার অ্যামেচার রেডিও ক্লাবের সভাপতি আবু হেনা মোস্তফা জামাল বলেন, কয়েক দিনের ভেতরেই এই উদ্যোগ খুলনার মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ এখন এটি ব্যবহার করে। খুলনায় একটা শক্ত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন তাঁরা। রাতে ৬০০ থেকে ৭০০ ব্যবহারকারী এতে সংযুক্ত থেকে কাজ করেন। এতে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, নাশকতা, অরাজকতাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের খবর তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন ও টহলরত টিমের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। এ ছাড়া টহল টিম নিজেদের ভেতর সমন্বয়, প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ ও সঠিক বণ্টন, কোনো এলাকায় জরুরি সাহায্যের আবেদন করলে দ্রুতই সেখানে উদ্ধারকারী দল পাঠানো, জরুরি চিকিৎসা সহায়তা, জরুরি রক্ত সরবরাহ, রাতে যানবাহন তল্লাশি ও যানবাহনের নিরাপত্তা প্রদান, বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, ধর্মীয় স্থাপনা পাহারা দেওয়ার মতো কাজ সহজ হয়েছে।