অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগী বা রোগীর আত্মীয়স্বজনের মনে হয়, চিকিৎসা যথাযথভাবে হচ্ছে না কিংবা চিকিৎসায় অবহেলা করা হয়েছে। এ নিয়ে চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কখনো কখনো চরম আকার ধারণ করে, গড়ায় আদালত পর্যন্ত। এ ধরনের দ্বন্দ্ব নিরসনই একজন মেডিকেল এথিসিস্টের (চিকিৎসা নীতিবিদ) কাজ। মেডিকেল এথিকস (চিকিৎসা নীতিবিদ্যা) বিষয়ে পড়ে, সনদ নিয়ে তাঁরা পেশাজীবী হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেন।
নতুন ধরনের এই পেশাতেই যুক্ত আছেন ফাহমিদা হোসেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক-প্রেসবিটেরিয়ান হাসপাতালের উইল করনেল মেডিকেল সেন্টারে ফেলো অব মেডিকেল এথিসিস্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে কথা হলো ১২ জুন। ফাহমিদা বলেন, ‘মেডিকেল এথিকস বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রেও নতুন। ২০ বছর ধরে এ বিষয়ের চর্চা হচ্ছে। এর আগে রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে মতানৈক্য হলে আদালত পর্যন্ত গড়াত। আমাদের কাজ হচ্ছে চিকিৎসা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব নিরসন। আজকের একটা ঘটনা বলি, আমাদের হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন এক রোগী। বাঁচার কোনোই আশা নেই। চিকিৎসকেরা কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার যন্ত্রপাতি খুলে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু রোগীর স্ত্রী কোনোভাবেই অনুমতি দিচ্ছেন না। বিষয়টা আমাদের কাছে এলে রোগীর স্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। তাঁকে বোঝাচ্ছি, আবার চিকিৎসকের সঙ্গেও কথা বলছি।’
মেডিকেল এথিকস বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে নিজের জীবনের শোকাবহ একটা ঘটনার কথা শোনালেন ফাহমিদা, ‘তখন আমার বয়স ১০ বছর। আমার ছোট ভাইয়ের বয়স ৭। ওর প্রচণ্ড মাথাব্যথা হতো। ডাক্তার সাধারণ মাথাব্যথা ধরে চিকিৎসা করতেন। কিন্তু খুব ঘন ঘন মাথাব্যথা হওয়ায় আমার মা এটাকে সাধারণ মাথাব্যথা হিসেবে মানতে পারছিলেন না। বলেছিলেন, “ওর মাথায় মনে হয় পানি জমেছে।” মায়ের কথা ডাক্তার তেমন পাত্তা দেননি। শেষমেশ ধরা পড়ল যে আমার ভাইয়ের মাথায় সত্যিই পানি জমেছে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার ছোট ভাইটি মারা যায়।’
ফাহমিদার মনে এই ঘটনা গভীর রেখাপাত করেছিল। তিনি বলেন, ‘তখন যদি কোনো মেডিকেল এথিসিস্ট থাকতেন, হয়তো চিকিৎসককে রোগীর অবস্থাটা বোঝানো যেত।’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের এমনিতেই মেডিকেল এথিকস পড়ানো হয়। ফাহমিদা জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালে যখন মেডিকেল এথিসিস্ট নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়, তখন চিকিৎসকদেরই এই কাজে নেওয়া হতো। কিন্তু দেখা গেল অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক এথিসিস্টরা চিকিৎসকদের পক্ষ নেন। তখন নিরপেক্ষ কাউকে এই কাজে নিয়োজিত করার কথা ভাবা হয়।
চিকিৎসাবিদ্যার বাইরের কেউ মেডিকেল এথিসিস্ট হতে চাইলে তাঁকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি করতে হবে। আর চিকিৎসক হলে এমডি ডিগ্রি থাকলে চলবে। ফাহমিদা হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ডুকেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২২ সালে গ্লোবাল হেলথ এথিকসে পিএইচডি অর্জন করেন। পিএইচডি করার পর প্রশিক্ষণ নিয়ে সনদ অর্জন করতে হয়েছে। মেডিকেল এথিসিস্ট হিসেবে কাজ করতে দরকার হয় এই সনদ। এসবের আগে ২০১৬ সালে ডুকেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিডারশিপ ও প্রফেশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর ফাহমিদা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক করেন। ২০১৩ সালে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
ফাহমিদা হোসেনের জন্ম ১৯৯০ সালের ২০ জুলাই। বাবা আলতাফ হোসেন ও মা ফরিদা হোসেন দুজনই ব্যবসায়ী। এক ভাই, এক বোনের মধ্যে ফাহমিদা ছোট। ২০১১ সালে খন্দকার তানভীর আহমেদকে বিয়ে করেন ফাহমিদা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেডিসিনাল কেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর করেছেন তানভীর। এই দম্পতির এক ছেলে যুয়াইব আহমেদের বয়স ৯ বছর।
মেডিকেল এথিসিস্ট হয়ে ওঠার পটভূমি বললেন ফাহমিদা—‘আমার পেশা ব্যবসার জগতে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি মানুষ নিয়ে কাজ করতে চাই। বিবিএতে মানবসম্পদ ছিল মুখ্য বিষয় (মেজর)। যুক্তরাষ্ট্রে এসে স্বাস্থ্যসেবায় আগ্রহী হয়ে উঠলাম। দেখলাম বায়ো এথিকস নামে বিষয় রয়েছে। বায়ো এথিকসের একটা অংশ হলো মেডিকেল এথিকস। তাই এ বিষয়ে পড়লাম। আমি চিকিৎসক হতে পারিনি, কিন্তু এখন হাসপাতালই আমার কর্মস্থল। যুক্তরাষ্ট্রে রোগী-চিকিৎসক দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনেক বেশি। আমরা (মেডিকেল এথিসিস্ট) রোগীদের পক্ষ বেশি নিই। রোগীর ইচ্ছাকে প্রাধ্যান্য দিই। ডাক্তার তো বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ করেন। আবার রোগী মনে করেন, শরীরটা তো আমার। আমরা রোগীদের কথা শুনি। এরপর চিকিৎসকদের সঙ্গে বসে রোগীর কথা তাঁকে বোঝাই। এখন অনেকেই মেডিকেল এথিকস বিভাগের প্রশংসা করছেন। অনেক গবেষণাও হচ্ছে।’
এর আগে ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিকেল সেন্টারে গবেষক ও ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ডে রিভিউয়ার হিসেবে কাজ করেছেন ফাহমিদা। এখন হাসপাতালে কাজের পাশাপাশি উইল করনেল মেডিসিন স্কুলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদেরও মেডিকেল এথিকস বিষয়ে পড়ান তিনি।
মেডিকেল এথিসিস্টদের মেডিকেল পুলিশ বলেও ডাকা হয়, জানালেন ফাহমিদা হোসেন। তিনি বলেন, ‘কাজটা খুব চ্যালেঞ্জিং। তবে ভালো লাগে। আমার খুব ইচ্ছা বাংলাদেশে কাজটাকে নিয়ে যাওয়া। ভারত ও পাকিস্তানে শুরু হয়েছে। তাই আমার মনে হয়, বাংলাদেশে মেডিকেল এথিকস নিয়ে কাজ শুরু হওয়া প্রয়োজন।’ আগামী মাসে ছয় সপ্তাহের জন্য দেশে আসবেন। এ সময়ে মেডিকেল এথিকস নিয়ে দেশে কাজ শুরুর ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে চান। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে রোগীদের পক্ষ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই আপাতত ফাহমিদা হোসেনের পরিকল্পনা।