নারীদের ছোট্ট একটি দল। সবার গায়ে সাঁতারের পোশাক। সেই সঙ্গে রয়েছে ইয়ার প্লাগ বা কানবন্ধনী, নোজ ক্লিপ বা নাসিকারক্ষক, চশমা, টুপিসহ নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় সব অনুষঙ্গ। ঝাঁপ দিয়েই প্রবল ক্ষিপ্রতায় চলে যাচ্ছেন জলাশয়ের অগভীর জলে। তুলে আনছেন বিয়ারের ক্যান, গলফ বল, মাছ ধরার টোপ, খেলনা, টুপি, জ্যাকেট, জুতা, টায়ার, মুঠোফোন বা ব্যবহৃত আতশবাজির বাক্স। বুঝতেই পারছেন, নেহাত শখের সাঁতারু কিংবা ডুবুরি নন তাঁরা। জলের তলদেশে থাকা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বর্জ্য-আবর্জনা পরিষ্কারের অনন্য উদ্যোগের অংশ হিসেবে এটি করছে এই নারীর দল। শুনলে অবাক হবেন, ছোট্ট এই দলটির সবার বয়সই কিন্তু ৬৪ থেকে ৮৫ বছর! বয়স তাঁদের বুড়ো করতে পারেনি। ৬৪ কিংবা ৮৫—বয়সের এসব মামুলি সংখ্যা কেড়ে নিতে পারেনি প্রদীপ্ত তারুণ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কেপ কড উপদ্বীপে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। দলবদ্ধ উদ্যোগটির নাম দিয়েছেন ‘ওল্ড লেডিজ এগেইনস্ট আন্ডারওয়াটার গারবেজ’। ২০১৭ সালে সাংগঠনিকভাবে যাত্রা শুরু করে এখন অবধি সহস্রাধিক জলাশয় পরিষ্কার করেছেন তাঁরা।
জলের তলে ঝুঁকি আছে—এ কথা মাথায় রেখেই তাঁরা কাজ করেন। প্রথমে একজন সাঁতারু সামনে গিয়ে রেকি করেন, ঝুঁকিপূর্ণ স্ন্যাপিং কচ্ছপ আছে কি না, খোঁজ করেন। এরপর বাকি সাঁতারুদের নিরাপদে এগিয়ে নিয়ে যান। জলের ওপর কায়াক নিয়ে অপেক্ষা করেন দলের অন্যরা। তল থেকে তুলে আনা আবর্জনা সংগ্রহ করেন তাঁরা। এরপর সবাই মিলে তীরে ফিরে আসেন। কুড়িয়ে পাওয়া বিচিত্র সব জিনিস নিয়ে আনন্দ-হাসিতে মেতে ওঠেন। কাঠের তক্তা, শিশুদের খেলনা, প্লাস্টিকের ঢাকনা, মাছ ধরার ছিপ, সিমেন্ট ব্লক, ময়লার ঝুড়ি, বৈদ্যুতিক তার, টয়লেটের কমোড—কী না থাকে!
এসব আবর্জনা কী করেন তাঁরা? ফেলে দেন? পুড়িয়ে ফেলেন? কিংবা নতুন কিছু তৈরি করেন? না, সেসব কিছু নয়। বর্জ্যগুলোর শৈল্পিক রূপ দেন। তারপর প্রদর্শন করেন আর্ট সেন্টারে।
বয়স হয়ে গেলে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়। দুর্বল হয়ে পড়ে শরীর। কর্মোদ্যম হারিয়ে যায়। কিন্তু ৬৪ পেরোনো বয়সেও শারীরিকভাবে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা মানে রীতিমতো ‘বোনাস’। এমনটিই মনে করেন ‘ওল্ড লেডিজ এগেইনস্ট আন্ডারওয়াটার গারবেজ’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা সুসান বাউর। তাঁর মতে, বার্ধক্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বৃদ্ধারাও দলবদ্ধভাবে এমন সব কাজ করতে পারেন, যা হয়তো মানুষের পক্ষে চিন্তা করাই সম্ভব নয়।
সুসান বলেন, ‘বৃদ্ধা’ পরিচয়টা সমাজে মোটেই সহজ কোনো ব্যাপার নয়। ৬৫ বছরের অধিক বয়সেও যখন এ ধরনের কাজ করার মতো যথেষ্ট সুস্থ আছেন, তখন এটি কিন্তু কৃতজ্ঞ হওয়ার মতো একটা ব্যাপার। আপনি কৃতজ্ঞ যে এসব করতে পারছেন। কৃতজ্ঞতা সবুজ গাছপালা, পরিষ্কার জলের প্রতি।
সুসান মনে করেন, ওল্ড লেডিজ এগেইনস্ট আন্ডারওয়াটার গারবেজের এই মহৎ উদ্যোগ কেবল জলাশয় বা পুকুর পরিষ্কার করা না; বরং প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়া এবং প্রকৃতি রক্ষার কাজ থেকে অর্জিত আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। উল্লেখ্য, এই সংগঠনে কেবল ৬৪–ঊর্ধ্ব বয়স্ক নারীরাই যুক্ত হতে পারেন।
স্নানের পোশাক পরা একদল বয়স্ক নারী এতটা আলোড়ন ফেলে দেবেন, এতটা আগ্রহ সৃষ্টি করবেন, এটি কিন্তু ভাবা যায়নি। সেটিই তাঁরা করেছেন। দারুণ সাড়া পড়েছে সর্বত্র। স্থানীয় গণ্যমাধ্যমে উঠে এসেছে তাঁদের কার্যক্রমের সচিত্র বিবরণ। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, রিডার্স ডাইজেস্ট, বস্টন টিভি, সিবিএস, এনপিআর প্রভৃতি মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসে কেপ কোড সংরক্ষণ সংস্থার (এপিসি) বার্ষিক সভায় বিশেষ স্বীকৃতি পুরস্কারও পেয়েছে সংগঠনটি।