রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) চলছে ‘জিপিএইচ ইস্পাত-প্রথম আলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি উৎসব ২০২৩’। এ উপলক্ষে লিখেছেন টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক।
ভর্তির এ মৌসুমে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের মনে দুটি প্রশ্ন অনেক সময়ই উঁকিঝুঁকি মারে—‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব? কোন বিষয় নিয়ে পড়লে আমার জন্য ভালো হবে?’ তাই তোমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় আছ, তোমাদের কথা মাথায় রেখেই আজ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করব।
যেকোনো শিক্ষার্থীর জীবনে উচ্চশিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ, এটার ওপর তোমার ক্যারিয়ারও অনেকখানি নির্ভর করছে। কিন্তু আমাদের অনেকেই কোনো ধরনের বাছবিচার না করে প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রথম পছন্দ বানিয়ে ফেলি। একবারও ভেবে দেখি না, এখানে আদৌ আমাদের পছন্দের বিষয় আছে কি না, পড়াশোনার মান এখন কেমন, অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক কতটা শক্তিশালী, নিজের বাসা থেকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব কতটা, আসা-যাওয়ার যাতায়াত ভাড়া কিংবা আনুষঙ্গিক খরচ কেমন, সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ কতখানি...। আসলে এই সবকিছু বিবেচনা করেই নিজের জন্য সেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি বাছাই করা উচিত।
কোন বিষয়টি তোমার জন্য
সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করা যেমন জরুরি, তেমনি কোন বিষয় নিয়ে পড়বে—তা নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। কোন বিষয়ে তোমার আগ্রহ, এর পাশাপাশি দেশে ও দেশের বাইরে চাকরির সুযোগ কেমন, ১০ বছর পর এর চাহিদা কেমন থাকবে, কোন কোন পেশায় যাওয়ার সুযোগ আছে—এগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে বর্তমান যুগে তুমি চাইলে বিবিএ পড়েও প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতে পারো। আবার কোডিং বা প্রোগ্রামিং শিখে যেকোনো সাধারণ বিষয়ে পড়েও তুমি নামী প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিসংক্রান্ত কাজ করতে পারবে। তাই নিজের আগ্রহের বিষয় নিয়ে পড়তে চাইলে কীভাবে এ সম্পর্কে আরও দক্ষ হওয়া যায়, সে বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
চাই দক্ষতা
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কেবল সনদ অর্জনের পেছনে ছুটলেই হবে না, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকে থাকতে হলে কিছু দক্ষতা নিয়েও বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই ঠিক করে নাও, কোন কোন কাজে তোমার ভালো দখল আছে। কারণ, নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার সঠিক সময় এটাই। ক্লাসে নানা কাজে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। তাই পাবলিক স্পিকিংটা ঝালাই করে নাও।
আজকাল যেকোনো কাজের জন্যই নেটওয়ার্কিংয়ের দরকার আছে। আর এটা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাবে যুক্ত হতে পারো। একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বা পৃষ্ঠপোষক (স্পনসর) খুঁজতে হলে তোমাকে নানা প্রতিষ্ঠানের নানা মানুষ বা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। আর এভাবেই নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। এসব নেটওয়ার্কিং চাকরির ক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে।
আয়ের অভ্যাস
অর্থ উপার্জন করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বেশ মোক্ষম সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। কোন কাজ করে তুমি অর্থ উপার্জন করতে পারো, তা বের করার জন্য ‘হেজহগ কনসেপ্ট’ অনুসরণ করা যায়। মার্কিন গবেষক, লেখক জিম কলিন্স তাঁর ‘গুড টু গ্রেট’ বইতে হেজহগ কনসেপ্টের ধারণা দিয়েছিলেন। এই কনসেপ্ট অনুযায়ী তোমাকে তিনটি বৃত্ত আঁকতে হবে। একটি বৃত্তে থাকবে যে কাজগুলো তুমি করতে পছন্দ করো, আরেকটায় থাকবে যে কাজগুলো তুমি আসলেই ভালো পারো। শেষ বৃত্তে থাকবে যে কাজগুলো করে তুমি আয় করতে পারো। তিনটি বৃত্ত যেই সাধারণ বৃত্তে এসে মিলবে, সেটাই তোমাকে অর্থ উপার্জনে সাহায্য করবে।
মাইক্রোসফট অফিসের কাজ যদি তুমি না পারো, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরি—দুই জীবনেই সংকটে পড়বে। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্টের কাজ শিখে ফেলতে পারলে তোমার অনেক কাজই খুব সহজ হয়ে যাবে।
যেকোনো কাজের জন্যই বাংলা ও ইংরেজির লিখিত দক্ষতা থাকাটা অনেক জরুরি। তাই ইংরেজি বলার পাশাপাশি ইংরেজি লেখাতেও জোর দাও। দুই সেমিস্টারের মাঝের বিরতিতে কার্যকর কিছু করার জন্য নিজেকে তাগাদা দাও। সবশেষে একটা ভালো বন্ধুর দল নির্বাচন করো। এমন নয় যে সব সময় একই দলের সঙ্গে তোমাকে থাকতে হবে। একেক কাজের জন্য একেক ফ্রেন্ড সার্কেল বানাতে পারো। তবে সব সার্কেলই যেন তোমার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
প্রস্তুতি নাও আগে থেকেই
প্রথম বর্ষেই ঠিক করে নাও, স্নাতকের পর তুমি কী করতে চাও। কারণ, চতুর্থ বর্ষে গিয়ে এত কিছু চিন্তা করার সময় থাকে না। তখন কীভাবে একটা চাকরিতে ঢোকা যায়, সবাই সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে। দেশে কাজ করতে চাও নাকি ভিনদেশে। দেশে থাকলে ঠিক করো, সরকারি চাকরি করবে নাকি বেসরকারি। সরকারি চাকরি করতে চাইলে বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়, দেখা শুরু করে দাও। বেসরকারি চাকরির জন্য নেটওয়ার্কিংয়ের দক্ষতায় জোর দাও। আর ইচ্ছা যদি থাকে বিদেশে যাওয়ার, তাহলে আগে ঠিক করো কোন কোন দেশে যেতে চাও। এরপর আইইএলটিএস, জিআরই বা জিম্যাটের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়, খোঁজখবর নাও। সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোর ওপর জোর দাও। সিভি, কভার লেটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন দাপ্তরিক লেখার চর্চা করতে থাকো। উদ্যোক্তা হতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই কাজ শুরু করে দাও। কারণ, এ সময় ‘অপরচুনিটি কস্ট’ কম থাকে। অর্থাৎ একটা কাজে মনোযোগ দিলে অন্য কাজে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
দেরি না করে এখনই একটা ক্যারিয়ার ম্যাপ তৈরি করো। ঠিক করো যে কোন কোন শিল্প খাতে (ইন্ডাস্ট্রি) কোন কোন পদে কাজ করতে চাও। তাদের চাহিদা দেখে বোঝার চেষ্টা করো, কীভাবে নিজেকে আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবে। সেখানে আগে থেকেই কর্মরত কোনো অ্যালামনাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো। কারণ, তাঁরাই তোমার মেন্টর বা পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে পারেন।
এভাবে সবদিক থেকে খেয়াল রেখে নিজের জন্য সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়টা নির্বাচন করতে হবে। মনে রাখবে, যেই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হও না কেন, যদি ঠিকঠাক পড়াশোনা করে ও দক্ষতা অর্জন করে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারো, তাহলে জীবনে সাফল্য লাভের পথে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।