বিশ্ববিদ্যালয়-ভর্তি কিংবা চাকরির পরীক্ষা। অনেক শিক্ষার্থীই ‘সাধারণ জ্ঞান’ অংশটি নিয়ে হিমশিম খান। অনেকে বলেন, এ শুধুই মুখস্থবিদ্যার খেল। সত্যিই কি তাই? গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, বদলে যাচ্ছে প্রশ্নের ধরন।
দুই ভাইয়ের সামনে দুই রকম চ্যালেঞ্জ। মুজাহিদুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এখন। ছোট ভাই রাকিবুল সদ্যই এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। তাঁর সামনে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা।
দুই ভাইয়ের পরীক্ষার ধরন ভিন্ন হলেও একটা জায়গায় মিল আছে। সাধারণ জ্ঞান এবং বাংলা ও ইংরেজি অংশের প্রস্তুতি। উলানবাটোর কোন দেশের রাজধানী, মাদাগাস্কারের ভাষার নাম কী কিংবা গুলট্রাম কোন দেশের মুদ্রা—মুখস্থ করতে করতে তাঁদের জান কয়লা। বসে-শুয়ে-দাঁড়িয়ে, কখনো চায়ের কাপ হাতে, কখনোবা যানজটে বসে তাঁরা শুধু পড়ছেন আর পড়ছেন।
কিন্তু এভাবে মুখস্থ করে কি আদৌ কাজ হবে? সাম্প্রতিক সময়ের প্রশ্নপত্রগুলো দেখলে বোঝা যায়, প্রশ্নের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। পুরোপুরি না হলেও মুখস্থনির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্নের ধরন পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই প্রস্তুতির ধরনেও পরিবর্তন আনা দরকার। পরিবর্তন দরকার কৌশলে।
বদলে যাচ্ছে প্রশ্নের ধরন
অনেকে মনে করেন, সাধারণ জ্ঞান মানেই তোতাপাখির মতো মুখস্থ করা। আদতে তা নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সাধারণ জ্ঞানে ৩০ শতাংশ যদি ‘মুখস্থবিদ্যা’ হয়, বাকি ৭০ শতাংশই বুঝে পড়া। বুঝে না পড়লে ঝারা মুখস্থ করেও এখন আর খুব একটা সুবিধা করা যায় না। সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাই হোক, কি বিসিএস।
বাংলা অংশ থেকে একটা উদাহরণ দিই। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় একটা সময় প্রশ্ন আসত, ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় ‘তাহারেই’ শব্দটা কতবার ব্যবহৃত হয়েছে; কিংবা ‘সোনার তরী’ কবিতায় মোট কয়টি যতিচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করা শুধু বিরক্তিকরই নয়, রীতিমতো বিভীষিকা। এখনো অনেক শিক্ষার্থী এগুলো মুখস্থ করতে গিয়ে হিমশিম খান। কিন্তু বিগত চার-পাঁচ বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এমন প্রশ্ন নেই। বরং এখনকার প্রশ্ন অনেকটাই অনুধাবনমূলক। অর্থাৎ একটা কবিতায় মোট কতগুলো যতিচিহ্ন আছে, সেটি গণনা করার চেয়ে পরীক্ষার্থী কবিতাটির অর্থ বুঝল কি না, সেটিই প্রাধান্য পাচ্ছে।
বিসিএস পরীক্ষায়ও এমন পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন প্রশ্নে এসেছে, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নষ্টনীড়” গল্পের বিখ্যাত চরিত্র কোনটি?’ প্রশ্নের সঙ্গে চারটি নাম দেওয়া আছে। নষ্টনীড় যে পড়েছে, চারুলতাকে চিনে নিতে তার নিশ্চয়ই অসুবিধা হবে না। এ জন্য মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই।
আবার ‘জেলে জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস কোনটি?’—এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে দুলে দুলে মুখস্থ করার দরকার নেই। সাহিত্য পড়ার অভ্যাস যার আছে, সে জানবে অপশনগুলোর মধ্য থেকে উত্তর হলো ‘গঙ্গা’। স্রেফ গাইডবইয়ের বহু নির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) দেখে মুখস্থ করে গেলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।
একইভাবে প্রশ্ন আসছে ইংরেজি সাহিত্য অংশ থেকেও। গৎবাঁধা কিছু গল্প–উপন্যাসের কিছু কিছু তথ্য মুখস্থ করলেই আগে হয়ে যেত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এই কৌশলে আর খুব একটা কাজ হচ্ছে না।
কীভাবে পড়ব ‘সাধারণ জ্ঞান’
‘সাধারণ জ্ঞান’ বিষয়টা আসলে পরীক্ষা প্রস্তুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিত্যদিনের অভ্যাসের অংশ করে ফেলা উচিত। প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়া, সারা বিশ্বে আলোচিত কী কী ঘটছে, সেসব ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা, এসবই তো ‘স্মার্ট’ মানুষের বৈশিষ্ট্য। এভাবে যে শুধু সাধারণ জ্ঞানের সাম্প্রতিক অংশে ভালো করা যায়, তা নয়। বরং ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটে অতীতের কোনো ঘটনা যদি থাকে, সেটাও জানা হয়ে যায়।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন আক্রমণ করল রাশিয়া। আর ২০২২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত হলো ৪৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি টেস্ট। সেখানে প্রশ্ন এসেছিল, ‘রাশিয়া ক্রিমিয়া আক্রমণ করে কত সালে?’ উত্তরটা হবে ২০১৪।
এই প্রশ্নটাও কিন্তু আসলে সাম্প্রতিক ঘরানার। অনেকের মনে হতে পারে ২০২২–এ এসে ২০১৪–এর ঘটনা কীভাবে সাম্প্রতিক হয়? কিন্তু ২০২২–এর ঘটনাক্রমই কিন্তু ২০১৪ সালের ঘটনাটিকে প্রাসঙ্গিক করেছে। পড়ার সময় এই কৌশলগুলোও মাথায় রাখা উচিত। কোনো গাইডবইয়ে হয়তো এসব পাবেন না। জানতে হবে নিজের আগ্রহে।
২০২২–এর শেষে মাশা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মরাল পুলিশিং ইস্যুতে আন্দোলন ছড়িয়ে গেল গোটা ইরানে। বিশ্বজুড়ে আলোচনায় চলে এল ওই আন্দোলন। এখন সাম্প্রতিক ঘটনা হিসেবে শুধু এই ২০২২ সালের আন্দোলনই নয়, বরং এর প্রেক্ষাপট বুঝতে চলে যেতে হবে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে।
প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় আরও একটা প্রশ্ন এসেছিল। ‘১৯৬৬ সালের ৬ দফার ভেতরে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত দফা ছিল কতগুলো?’ এই প্রশ্নের উত্তর করার জন্য কিন্তু শুধু ছয়টি দফা মুখস্থ করলেই কাজ হবে না। বরং বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে।
বুঝে পড়ি, আগ্রহ নিয়ে পড়ি
নিয়মিত পত্রিকা পড়লে কিংবা নির্ভরযোগ্য পত্রিকার অনলাইনে চোখ রাখলে স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু সাম্প্রতিক ও প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলি আপনার চোখে পড়বে। ফেসবুকে সংবাদভিত্তিক পেজগুলো অনুসরণ করলেও ‘মি টু’ থেকে শুরু করে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন কিংবা রেহানা মরিয়ম নূর নামের চলচ্চিত্র, যখন যা কিছু আলোচিত, সবই আপনার গোচরে থাকবে, মুখস্থ করার দরকার পড়বে না। উদাহরণ হিসেবে যে তিনটি বিষয়ের কথা বললাম, এগুলো নিয়ে কিন্তু গত দুই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে। তাই বলি, সাধারণ জ্ঞান শুধু মুখস্থ করার জন্য নয়, বরং দৈনন্দিন অভ্যাসের অংশ করা উচিত।
আরেকটি কৌশল খুব কাজে দেয়। তা হলো বিষয় ধরে ধরে, বুঝে বুঝে পড়া। যেমন কেউ হয়তো পড়ার স্বার্থে স্রেফ মুখস্থ করে গেল যে ১৯১৯ সালে খিলাফত আন্দোলন হয়েছিল। প্রেক্ষাপট না জেনে বিরক্তির সঙ্গে স্রেফ তথ্যটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখল। কিন্তু বিষয়টা বুঝে পড়ার চেষ্টা যদি করত; মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড ও তুরস্কের (তৎকালীন অটোমান খিলাফত) সম্পর্ক কেমন ছিল, বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশরা কী কথা দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাদের ওয়াদা ভেঙে অটোমানদের সঙ্গে কী করেছিল, বাঙালি মুসলমানরা কীভাবে ব্রিটিশদের ওই প্রতারণার পরিপ্রেক্ষিতে শেষমেশ একটা আন্দোলন গড়ে তুলল—এসবও যদি জানত, তাহলে কিন্তু সহজেই তথ্যগুলো মাথায় জায়গা করে নিত। প্রেক্ষাপট জানলে পড়ার আগ্রহ জাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা চাকরির পরীক্ষা—যেকোনো ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট বুঝে পড়াটা কাজে লাগে। এমসিকিউ ছাড়াও বিসিএস পরীক্ষায় লিখিত অংশ আছে। এই অংশের জন্য বিশ্লেষণ করে পড়া ছাড়া উপায় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নেও এখন লিখিত অংশ যুক্ত হয়েছে।
ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরন। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি প্রস্তুতির ধরনও না বদলান, তবে কিন্তু পিছিয়ে পড়বেন।