দ্য পারস্যুট অব হ্যাপিনেস ছবিটা দেখেছেন?
উইল স্মিথ অভিনীত এই সিনেমাটা দেখেই দুই ভাই ফয়জুল কবির আর ফয়সাল আহমেদের মাথায় রুবিকস কিউবের ভূত চাপে। ভিডিও, আর্টিকেল, ব্লগ—অনলাইন থেকে নানা কিছু দেখে তাঁরা দ্রুত শিখে নিয়েছিলেন বিভিন্ন ডিজাইন ও অ্যালগরিদমের ব্যবহার। ফলে কিউব মেলানো রপ্ত করতে বেশি দিন সময় লাগেনি। সেটা ২০২১ সালের কথা।
এই রুবিকস কিউব নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতেই একজন ইতালীয় শিল্পীর খোঁজ পান ফয়জুল। ৭০০ রুবিকস কিউব দিয়ে যিনি মোনালিসার প্রতিকৃতি বানিয়েছেন। এ রকম আরও বহু প্রতিকৃতি তৈরি করেছেন তিনি। ব্যাপারটা ফয়জুলকে বেশ অনুপ্রাণিত করে। ঠিক করে ফেলেন, তিনিও এ রকম একটা কিছু করবেন।
প্রথম দিকে রুবিকস কিউব দিয়ে প্রতিকৃতি বানানোটা অসম্ভবই মনে হতো তাঁর কাছে। কারণ, রুবিকস কিউবে আছে ছয়টি মাত্র রং। তার ওপর একেকটা কিউব দিয়ে প্রায় ৪৩ কুইন্ট্রিলিয়ন (৪৩-এর পর ১৮টি শূন্য বসিয়ে নিন) কম্বিনেশন বানানো সম্ভব। অতএব কাজটা সহজ নয় একেবারেই। তাই বলে ফয়জুল হাল ছাড়লেন না। চালিয়ে গেলেন অনুশীলন।
ভাইকে জানানোর পর তাঁরও সমর্থন পাওয়া গেল। দুই ভাই ভিন্ন দুটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কাজের ফাঁকেই চলল তাঁদের শখ পূরণের চেষ্টা। কিন্তু শখের তোলা যে ৮০ টাকা, কাজ শুরু করেই টের পেলেন তাঁরা। প্রতিকৃতিটা বানাতে অনেকগুলো রুবিকস কিউব প্রয়োজন। এত রুবিকস কিউব কিনতে যত টাকা প্রয়োজন, সংখ্যাটা দুই ভাইয়ের জন্য মোটামুটি ভ্রু কপালে তোলার মতো। তবু দুজন মিলে টাকা জমানো শুরু করেন। একসময় কিনে ফেলেন ৬০০ রুবিকস কিউব।
কাজটা কিন্তু বেশ জটিল। দিনের পর দিন চেষ্টা করতে করতে একসময় সফল হন তাঁরা। প্রথমে সঠিক ছবি নির্বাচন করতে হয়, ফটোশপের মাধ্যমে ঠিকঠাক করতে হয় রং। সম্পাদনা সফল হলে তারপর শুরু হয় কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে ছবিটিকে পিক্সেলে রূপান্তরের কাজ। লে-আউট তৈরি করে সে অনুযায়ী কিউব মেলান ফয়জুল। শুরুর দিকে মাটিতে কিউব রেখে পোর্ট্রেট তৈরি করতেন ফয়জুল। পরে আসবাবের দোকান থেকে একটা কাঠের কাঠামো তৈরি করে নেন। এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাষাশহীদ আবদুস সালাম, লেওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত মোনালিসা, জোকার, বাংলাদেশের মানচিত্র, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসি, বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, ব্রেকিং ব্যাড সিরিজের হাইজেনবার্গ, কেজিএফ সিনেমার রকি ভাইসহ বহু পোর্ট্রেট বানিয়েছেন। তবে ফয়জুলের সবচেয়ে পছন্দের কাজ ভাষাশহীদ আবদুস সালামের পোর্ট্রেটটি। কারণটাও নিজেই স্পষ্ট করলেন। ‘এটা ছিল আমাদের প্রথম কাজ। কাজটা শেষ হলে প্রথমবারের মতো সাহস পাই যে আমরা আসলে কাজটা করতে পারব। তবে সাকিব আল হাসানের কাজটা আমাদের আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।’
ধরন ও আকারভেদে রুবিকস কিউব নানা রকমের হতে পারে। ফয়জুলের কিউবগুলো ছিল ৩ X৩ X ৩ ধরনের। একটা পোর্ট্রেট বানানোর পর আরেকটা বানাতে হলে পুরোনোটা ভেঙে ফেলতে হয়। আবার কাজটাও বেশ শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। শুরুর দিকে একটা পোর্ট্রেটের পেছনেই ১২ ঘণ্টা সময় লাগত। একটানা কাজ করলে হাত, পা, পিঠ, কোমরব্যথা হয়ে আসত। এখন অবশ্য সেই সময়কে সাত-আট ঘণ্টায় নিয়ে এসেছেন ফয়জুল। জানালেন, একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে রাতের পালায় (নাইট শিফট) চাকরি করেন। সাত-আট ঘণ্টা সময় বের করা তাঁর জন্য কঠিন। প্রতিদিন একটু একটু করে কিউব মিলিয়ে বক্সে রাখেন। এরপর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মেলানো কিউব ফ্রেমে বসিয়ে ভিডিও বানান।
নিজের কাজগুলোর ছবি-ভিডিও নিয়মিত ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজেও তুলে রাখেন তিনি। নিজের কাজগুলো সবার কাছে পৌঁছে দিতে চান। যেন অন্যরা, বিশেষ করে শিশুরা, সৃজনশীল কাজে আগ্রহী হয়। সেই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীগুলোতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছাও তাঁর আছে।