‘অ্যাপলে কাজ করতে হলে বিশ্বাস করতে হবে, ১ +১ = ৩’

অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে চেনে সারা পৃথিবী। অথচ তিনিই একসময় পত্রিকা বিলি থেকে শুরু করে বার্গার বানানোর কাজও করেছেন। এমন অনেক অজানা তথ্যই টিম কুক দিয়েছেন ডুয়া লিপাকে। মার্কিন এই গায়িকার সঞ্চালনায় বিবিসি সাউন্ডসের একটি আয়োজনে নিজেকে মেলে ধরেছেন টিম। পড়ুন তাঁর কথামালার নির্বাচিত অংশ।

টিম কুক
ছবি: রয়টার্স

আমার রুটিন

ঘুম থেকে উঠি ভোর চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে। দিনের প্রথম ঘণ্টা কাটে ই–মেইলের সঙ্গে। এই কাজ আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে করি। গ্রাহক থেকে শুরু করে অ্যাপলের কর্মী—সবার ই–মেইলই মন দিয়ে পড়ি। গ্রাহকের কাছ থেকে জানতে পারি, তাঁরা কী পছন্দ করছেন, কোথায় পরিবর্তন আনা দরকার। কর্মীরাও আমাকে ই–মেইলে নানা পরামর্শ দেন। এটা আদতে সবার সঙ্গে একই কাতারে থাকার উপায়; সবাই কী ভাবছেন, অনুভব করছেন, জানার উপায়।

অফিসে যাওয়ার আগে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ব্যায়াম। ব্যায়ামাগারে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরাই। আমার একজন প্রশিক্ষক আছেন, যাঁর কাজই হলো যা যা করতে চাই না, আমাকে দিয়ে তা করানো। এই এক ঘণ্টা ফোন হাতে নিই না। ব্যায়ামেই দিই পূর্ণ মনোযোগ।

এরপর গোসল করে অফিসে যাই। সময় কাটাই পছন্দের মানুষদের সঙ্গে। আমরা বিশ্বাস করি, ১ + ১ = ৩। আপনার আইডিয়া আর আমার আইডিয়া যোগ করলে তা নিশ্চয়ই আলাদা আলাদা আইডিয়ার যোগফলের চেয়ে বেশি কিছু।

আমার সারাটা দিন ভাগ করা থাকে আলাদা আলাদা দলের জন্য। কখনো প্রোডাক্ট টিম, কখনো মার্কেটিং টিম। দিনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলাপ তো হয়ই, তবে বেশির ভাগ আলোচনাই হয় ভবিষ্যতে চোখ রেখে।

কেমন ছিল ছেলেবেলা

মা ছিলেন ফার্মেসির কর্মী, বাবা কাজ করতেন জাহাজ কারখানায়। শ্রমজীবী পরিবারে বড় হয়েছি বলেই সংসারে টাকা ছিল অল্প, কিন্তু ভালোবাসা ছিল অনেক। খুব ছোটবেলায়ই তাই পরিশ্রমের মূল্য শিখে গিয়েছিলাম মা-বাবার কাছ থেকে। ১৩ বছর বয়সে আমি হকারি শুরু করি। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা বিলি শুরু করতাম। এরপর বার্গার বানানো থেকে শুরু করে আরও নানা রকম কাজ করেছি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, কোনো রকমে কলেজে ভর্তি হতে হবে।

জাহাজ কারখানার চাকরিতে প্রায়ই বড় ধরনের ছাঁটাই হতো। বাবাকে যেহেতু এই দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি, তাই সব সময় চেয়েছিলাম, কলেজে পড়ে ভালো কোথাও কাজ করব। শেষ পর্যন্ত আলাবামার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—অবার্নে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাই।

বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই বাইরের পৃথিবীটা আমার চোখের সামনে প্রথমবারের মতো প্রতীয়মান হয়। যেহেতু অনেক রকম কোর্স বাছাইয়ের সুযোগ ছিল, হয়ে উঠছিলাম আরও কৌতূহলী। এরপর আইবিএমে কাজ শুরু করি। গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিউকে ভর্তি হই। এভাবেই একসময় থিতু হই অ্যাপলে।

তবে অ্যাপলের মতো কোথাও কাজ করার কথা কখনো কল্পনাও করিনি। হাইস্কুলে পড়ার সময় ইচ্ছা ছিল গায়ক হব। জ্যাজ ব্যান্ডের সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু কেন যেন মনে হতো, গানে আমি কখনোই ভালো করতে পারব না। যেহেতু গণিত আর বিজ্ঞান ভালো লাগত, একসময় প্রকৌশলেই ঝুঁকে পড়লাম।

অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে চেনে সারা পৃথিবী। অথচ তিনিই একসময় পত্রিকা বিলি থেকে শুরু করে বার্গার বানানোর কাজও করেছেন।

চোখ বনাম পর্দা

স্মার্টফোনে মানুষ যে পরিমাণ সময় দেয়, তা সত্যিই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। সত্যি বলতে এ কারণেই কিন্তু আমরা আইফোনে ‘স্ক্রিন টাইম’–সেবা চালু করেছি। এর মাধ্যমে মানুষ অন্তত দেখতে পাবেন যে তিনি কোন অ্যাপে কতটা সময় ব্যয় করছেন। একই কথা অ্যাপল ওয়াচের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য; যা আপনাকে হাঁটতে, নড়াচড়া করতে, ক্যালরি ঝরাতে উৎসাহ দেবে। দিনে আপনি কয়টি নোটিফিকেশন পাচ্ছেন, সেই হিসাব রাখার ব্যবস্থাও আমরা করেছি। কখনো কখনো বিষয়টা এমন—হয়তো আপনি ফোনের পেছনে খুব বেশি সময় দিচ্ছেন না, কিন্তু বারবারই আপনার কাজে বিঘ্ন ঘটছে। সবার জন্য এই সেবা চালু করার আগে প্রথমবার যখন নিজে এটা ব্যবহার করেছি, তখন নোটিফিকেশনের মোট সংখ্যা দেখে চমকে গিয়েছিলাম। নিজেরই বিব্রত বোধ হচ্ছিল। তখনই আমি বিভিন্ন নোটিফিকেশন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ঠিক করি, এগুলো দিনের শেষে দেখব।

আমি সব সময় বলি, যখন দেখবেন, আপনি মানুষের চোখের দিকে তাকানোর চেয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন, বুঝবেন ভুল শোধরানোর সময় এসেছে।

যাঁরা অ্যাপলে কাজ করতে চান

আমরা নানা ধরনের মানুষকে নিয়োগ দিই। কারও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, কারও নেই। কেউ কোডিং জানেন, কেউ জানেন না। তবে আমি বলব, কোডিংটা সবার শেখা উচিত। কারণ, এটা নিজেকে প্রকাশ করারই একটি মাধ্যম। বলতে পারেন, একটি বৈশ্বিক ভাষা। এই একটা ভাষার ওপর পৃথিবীর সব দেশকেই নির্ভর করতে হয়।

আমার নেতৃত্বের ধরনটাই হলো এমন—আমি চাই সবাই অংশগ্রহণ করুক, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করুক। তাই এমন লোক খুঁজি, যিনি মিলেমিশে কাজ করতে জানেন। যিনি বিশ্বাস করেন, ১ +১ = ৩। কৌতূহলী মানুষ চাই। এমন মানুষ চাই, যিনি প্রশ্ন করেন। জানতে চান, কোনটা কীভাবে কাজ করে। সৃজনশীল মানুষ আমার পছন্দ। কারণ, এমন পণ্যই তো আমরা তৈরি করতে চাই, যে পণ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা এখনো মানুষ জানেই না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত