নজরুলের গানে আলোড়িত হচ্ছে তরুণেরাও

আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। এই প্রজন্মের ব্যান্ড সংগীতশিল্পীরা ঝুঁকছেন নজরুলের অসামান্য সৃষ্টির দিকে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আজ গান হয়ে ঝড় তুলছে গিটারে, কি–বোর্ডে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নজরুলের গান আলোড়িত করছে তরুণদের। নজরুলের গান নিয়ে ২০১২ সালের ২২ মে নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত লেখাটি আবার দেওয়া হলো।

মেটাল ঘরানার ব্যান্ডগুলোর নজরুলসংগীতের প্রতি আগ্রহ বেশি

‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল।’ ভূপেন হাজারিকার গানের কথাগুলো আজও কী দারুণ সত্যি! হৃদয় বলুন, চেতনা বলুন, সবখানেই আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলাম। দুজনেই মিশে আছেন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে। একজন যদি হন হৃদয়ের বাম অলিন্দ, অন্যজন ডান অলিন্দ। একহাতে বাজে অগ্নিবীণা, কণ্ঠে গীতাঞ্জলি। তাই তো একজনকে আমরা বলি বিশ্বকবি। আরেকজনকে আমরা নিজের করে নিয়েছি ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে। আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। তিনি গত হয়েছেন কতটা দিন হয়ে গেল। আজও নজরুল আরও কত রূপে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন আমাদের। তিনি শুধু বিদ্রোহী কবি নন। ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ’ও। আর তাঁর কবিতা ও গানের মতোই চিরকাল এই মহান পুরুষতরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা।

এই প্রজন্মের ব্যান্ড সংগীতশিল্পীরা ঝুঁকছেন নজরুলের অসামান্য সৃষ্টির দিকে

ব্যান্ডসংগীত আর পপ-রকের তোড়ে কি নজরুলের গান ভেসে যাবে? আজ আর সেই শঙ্কার দিন নেই। উল্টো আমাদের এই প্রজন্মের ব্যান্ড সংগীতশিল্পীরা ঝুঁকছেন নজরুলের অসামান্য সৃষ্টির দিকে। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আজ গান হয়ে ঝড় তুলছে গিটারে, কিবোর্ডে। কবীর সুমনের গানের ভাষায় আজকের তরুণ প্রজন্ম ‘হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খাচ্ছে সেই অমিয় সুধা’। তারুণ্যের পরিধেয় টি-শার্টের বুকজুড়ে আছেন নজরুল। স্রেফ লোক দেখানো ব্যাপার নয়। নজরুল সত্যিই আছেন তাদের মন আর মননের সঙ্গে মিশে।

আজকের তরুণ নির্দ্বিধায় বলে দেয়, ‘আমি নজরুলের ফ্যান।’ সেটা যেমন গানের জন্য, তেমনি তাঁর দুঃখভরা জীবনের সব কষ্ট ছাপিয়ে ‘আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ!’ জীবনযাত্রার জন্যও।

এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নজরুলের গান শুনছে। তাঁর গানের বাণীর সঙ্গে মেলাতে পারছে নিজেদের জীবনটাকে। আর তাঁর জীবন থেকেই খঁুজতে চাইছে প্রেরণা। ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত জরিপে এটা তো উঠে এসেছেই। নজরুলের গান নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে প্রচুর।

তরুণদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে ব্যান্ড আর্টসেলের গাওয়া ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু’। গ্রামীণফোনের আয়োজনে ‘আমার সুরে স্বাধীন বাংলা’ শিরোনামের কনসার্টে তারা প্রথম গায় গানটি। তারপর থেকে যেন আর্টসেলের কনসার্ট মানেই এ গানটি থাকবেই। ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য সেজান জানান, ‘তখন মনে হয়েছিল আমাদের গায়কীর সঙ্গে এ গানটিই সবচেয়ে ভালো লাগবে। এর কথা আর সুরের যে শক্তি তা অনবদ্য। অনেক খেটেছি আমরা গানটা তোলার জন্য। আমাদের দলের গায়ক লিংকনের মা বেতারের শিল্পী ছিলেন। তিনি সাহায্য করেছেন আমাদের। মূল সুরটা ঠিক রাখার জন্য খুব সাবধান ছিলাম আমরা।’

‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম...’ গানটি গেয়েছে ব্যান্ডঅ দৃক। পাওয়ারসার্জ গেয়েছে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’।

নজরুলের গানে ছন্দের চেয়ে অনেক বেশি কিছু আছে বলে মনে করেন তাঁরা

মনে হচ্ছে মেটাল ঘরানার ব্যান্ডগুলোর নজরুলসংগীতের প্রতি আগ্রহ বেশি। আর এ কারণেই হয়তো তরুণদের কাছে তা বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আর্টসেলের সদস্য সেজান বললেন, ‘এই সময়ের হেভি মেটাল বা থ্র্যাশ মেটাল ধারার গানের সঙ্গে নজরুলের তারুণ্যের শক্তির একটা মিল আমি খঁুজে পাই।আমি ভাবতেই পারি না, নজরুল সফট রক বা পপ গান গাইছেন। তাঁর ভাবমূর্তি আমার কাছে এমনই। তিনি কিন্তু সেই সময়ে একটা ভিন্ন পথেই হেঁটেছেন। আমরাও তো সেই চেষ্টা করছি। তাঁর সুর আর কথার যে শক্তি, তা সব সময়ের জন্যই অর্থবহ। আর কে এমন করে বলতে পারে “হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কান্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’

সুর আর তালে তাল মেলানো নয়, বরং বাণী বুঝেই নজরুলকে হৃদয়ে ধারণ করার পরামর্শ দেন শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। ‘দেখা যায়, নজরুলের গানের তালের জন্যই হয়তো কারও গানটা শুনতে ভালো লাগছে। কিন্তু বাণীটা সে বুঝল না। এটা দুঃখজনক। উন্মাদ হয়ে গান ভালোবাসা যায়। আবার চোখ বুজে শুধু অনুভব করাও যায়। শুধু ছন্দের চেয়েও অনেক বেশি কিছু আছে নজরুলের গানে। এটা আমাদের তরুণেরা বুঝতে পারলেই হলো। যারা এখন নজরুলের গান গাইছে, তাদের সাধুবাদ জানাই। তবে গানে যন্ত্রের ব্যবহারটা যেন গানকে ছাপিয়ে না যায়।’

সংগীত নিয়ে প্রজন্মে প্রজন্মে এমন ভাবনা থাকবেই। তবে যে যখন তরুণ তাকেই আলোড়িত করছে নজরুল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কে আর এমন পারে?