উজবেকিস্তান পর্ব ৪

তৈমুর লংয়ের সমাধিতে গিয়ে যে গল্প শুনলাম

সমরখন্দের রেগিস্তান স্কয়ার
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

উজবেকিস্তান সফরে সমরখন্দ আমাদের শেষ শহর। বুখারা থেকে এখানে এসে সিল্ক রোডের একটি হোটেলে উঠেছি। দেশটি ভ্রমণে সমরখন্দেই বেশি ঠান্ডা অনুভব করছি। হোটেল, রেস্তোরাঁ বা গাড়িতে অবশ্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত, ঠান্ডার আঁচ পাওয়া যায় না। বিকেল নাগাদ বেরিয়ে পড়া গেল। জায়গাটার নাম রেগিস্তান স্কয়ার। এই স্কয়ার ঘিরেই শহরের বেশির ভাগ হোটেল–রেস্তোরাঁ। জমজমাট জায়গা। রাত পর্যন্ত ছিলাম। দেখার মতো আলোকসজ্জা—লাল, সবুজ, নীল, বেগুনি ও হলুদ রঙের আলোয় ঝলমল করছে। দর্শনার্থীরা ছবি তুলছেন, দেখছেন, ভিডিও করছেন।

পরদিন সকালে গাইড আদমের সঙ্গে গেলাম ‘শাহ-ই-জিন্দা’। অমাদের দেশে যেমন কক্সবাজার, ভারতে যেমন তাজমহল, উজবেকিস্তানে তেমনই শাহ-ই-জিন্দা, অন্তত আমার কাছে তা–ই মনে হয়েছে। স্থাপনাটি মূলত সমাধি। শাহ-ই-জিন্দা অর্থ ‘জীবিত রাজা’। এই রাজা হলেন খুতাম ইবনে আলী আব্বাস। সপ্তম শতকে ইসলাম প্রচারে এখানে এসেছিলেন তিনি। আমাকে ইতিহাসের চেয়েও আকৃষ্ট করেছে সমাধিস্থলটির নির্মাণশৈলী, টালির নকশা। প্রথম দিককার বিল্ডিংগুলো একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকের দিকে তৈরি হয়, আর চতুর্দশ থেকে পঞ্চদশ শতকে এসে নির্মিত হয় মূল অংশ। প্রতিটি টালি হাতে বানানো। তিনটি অংশে ভাগ করা এত বড় স্থাপনার এত নিখুঁত নকশা, কাছ থেকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। নীল, সবুজ, প্যাস্টেল, গাঢ় নীল, হলুদ, সাদা—এই কয়েকটা রং দিয়ে অভাবনীয় নকশায় তৈরি এই শাহ-ই-জিন্দা। প্রতিটি নকশার খুঁটিনাটি লক্ষ করে করে শুধুই অবাক হচ্ছিলাম। উজবেকিস্তানের যে কটা স্থাপনা দেখতে গিয়েছি, শাহ-ই-জিন্দার নকশা আমাকে মুগ্ধ করেছে বেশি।

গুর-ই আমির দেখতে গিয়ে

তবে গাইড আদমের মতে, সমরখন্দের সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনা বিবি-খানমের মসজিদ, সেটাও দেখে এলাম। বড় জায়গাজুড়ে বিশাল স্থাপনা। মূল ফটকই তিন-চারতলা বিল্ডিংয়ের সমান। সে কী নকশাখচিত দরজা! মাথা উঁচু করে দেখতে দেখতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল।

সেদিনই পরে ‘গুর-ই আমির’ দেখতে যাই। এটা তৈমুর লংয়ের সমাধিস্থল। সমাধিটিকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত আছে। তেমনই একটি গল্প শোনাই।

১৯৪১ সালের ২০ জুন সোভিয়েত প্রত্নতাত্ত্বিক মিখাইল মিখাইলভিচ গেরাসিমভ সমাধিটি উন্মোচিত করেন। কথিত আছে, খোলার পর কবরের ভেতরে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়, তাতে লেখা, ‘যে আমার সমাধিকে বিরক্ত করবে, সে আমার চেয়েও ভয়ানক এক আক্রমণকারীকে মুক্তি দেবে।’ আর সত্যিই এর ঠিক দুদিন পর ১৯৪১ সালের ২২ জুন রাশিয়া আক্রমণ করেন হিটলার। শুরুর দিকে হিটলারের কাছে মারাত্মকভাবে ধরাশায়ী হতে থাকে সোভিয়েত বাহিনী। কিছু মুরব্বি তখন স্তালিনকে এই অভিশাপের কথা জানালে স্তালিনও এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তিনি তৈমুরকে পুনঃসমাহিত করার নির্দেশ দেন। ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর সম্পূর্ণ ইসলামি রীতিতে আবার তাঁর দেহাবশেষ সমাহিত করা হয়। এর প্রায় এক মাস পর স্তালিনগ্রাদ পুনরুদ্ধার করে সোভিয়েত। নাৎসিরা আত্মসমপর্ণ করে আর যুদ্ধে জয়ী হন স্তালিন। তবে এসবই গল্পগাথা।

তৈমুর লংয়ের ভাস্কর্য

গুর-ই আমির দর্শন শেষ করে আমরা গেলাম উলুগ বেগের জাদুঘরে। উলুগ বেগ তৈমুর লংয়ের নাতি। জাদুঘর ঘুরে ঘুরে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তাঁর কীর্তিগাথা। ওই সময়েই তিনি জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন। জাদুঘরের একটা ছবিতে লেখা ছিল, যাঁরা মাদ্রাসায় পড়তে আসতেন, তাঁদের তিনি টাকা দিতেন। তাঁর সম্মানে করা জাদুঘর ঘুরে একটা কথাই আমার মনে হয়েছে, সময়ের চেয়ে কয়েক শতক এগিয়ে ছিলেন তিনি।

সারা দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, তারপরও পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। ফেরার পথে কী প্রসঙ্গে যেন গাইড আদম বলছিলেন, তাঁদের দেশ খুবই নিরাপদ। আসলেই তা–ই, বারবার ব্যাগ চেক করতে হবে না। আমি যত দেশে গেছি, উজবেকিস্তান আমার অবিশ্বাস্য রকম নিরাপদ লেগেছে। আদমকে বিদায় দিলাম। পরদিন বিকেলে সমরখন্দ ছাড়ব আমরা। মহি জিজ্ঞাসা করল, ‘সকালে কী করবা?’ বললাম, আপাতত হোটেলে গিয়ে ঘুমাব।

করলামও ঠিক তা–ই।

সকালে নাশতা করার সময় জানতে পারলাম, মহি এর মধ্যে ঠিক করে ফেলেছে, আমরা কই যাব। ভ্রমণ আর চিকিৎসাসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে চোখ বুজে তাকে বিশ্বাস করি। চমৎকার সফর পরিকল্পনা করে সে। আমরা গেলাম কনিগিল নামের এক গ্রামে। যেখানে প্রাচীন পদ্ধতিতে মালবেরি গাছের বাকল থেকে হাতে কাগজ তৈরি করা হয়। এই জায়গায় কাগজ তৈরির ধাপগুলো পর্যটকদের দেখানো হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রবেশমূল্য ১৫০ টাকা। দু–তিনজন কাগজ তৈরির ধাপগুলো দেখান, আরেকজন ইংরেজিতে বর্ণনা দিতে থাকেন। প্রতিটি ধাপ দেখার মতো—বাকল ছাড়ানো, সেদ্ধ করা, পানি শোষণ করা, ছেঁকে শুকানো, সবশেষে পলিশিং। দু-তিন শ বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকে এই কাগজ। একধরনের তৃপ্তি নিয়ে শহরের দিকে চললাম।

শেষবারের মতো রেগিস্তান স্কয়ারে এলাম। দিনের আলোয় জায়গাটা আরেকবার দেখার ইচ্ছা। সেখানে কাজাখস্তানের কিছু পর্যটক ছিলেন, তাঁরা কাছে এসে কথা বললেন, ছবি তুললেন, তাঁদের দেশে যাওয়ার দাওয়াত দিলেন। তৃপ্তি নিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করে হোটেল ফিরে কনসিয়ারজের থেকে লাগেজগুলো নিয়ে ছুটলাম রেলস্টেশনের দিকে। গন্তব্য তাসখন্দ। তারপর ভারতের দিল্লি হয়ে ঢাকার ফ্লাইটে উঠে বসব। (চলবে)

*আগামী পর্বে থাকছে উজবেকিস্তান ভ্রমণের খুঁটিনাটি তথ্য