মাদাগাস্কারে যেতে আমাদের ভিসা লাগেনি, তবে...

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব

মাদাগাস্কারের বিমানবন্দরে
ছবি: সংগৃহীত

মাদাগাস্কার নিয়ে ভাবনা অনেক দিনের। বাংলাদেশ থেকে কূটনৈতিক জটিলতা ছাড়া যেসব দেশে যাওয়া যায়, তার মধ্যে এই দেশও আছে। তবে চেনা–পরিচিতের মধ্যে ভ্রমণকারীর সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেল চালাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা চারজন। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ গুণ। সাইকেল চালানোর রাস্তার অভাব হবে না,Ñযাওয়ার আগে এই ছিল আমাদের ভরসা।

গন্তব্য ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তথ্যের জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। কিন্তু ইন্টারনেটে তথ্য বলতে পেলাম গাইডেড ট্যুরের অনেক এজেন্সির নাম। দেশের কোন দিকে দেখার কী আছে, তা-ও পাওয়া গেল, তবে সবই এজেন্সির মাধ্যমে সারতে হবে। মাদাগাস্কারে সাইকেল ট্যুরও হয়। কিন্তু সবই সহায়তা নিয়ে। মানে হলো, আপনি একটা দলের সঙ্গে মিশে সাইকেল চালাবেন। তারাই সব ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু এ আমার ধাতে সয় না!

মাদাগাস্কারে বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট

মাদাগাস্কারের রাস্তাঘাটের যে তথ্য পাওয়া গেল, তা কিন্তু শঙ্কাজনক। পুরো দেশের রাস্তার দশ শতাংশের কম অংশ পাকা! আমরা পাকা রাস্তায় চালাতে চাই। আমাদের ট্যান্ডেমের চাকা ছোট,Ñকুড়ি ইঞ্চি; আর চওড়ায় দুই ইঞ্চির নিচে। বেশ সরু চাকা। এ ধরনের চাকা তৈরি হয় পাকা রাস্তা বা পেভড রোডে চালানোর জন্য। পাকা রাস্তা দেশের সব দিকেই আছে, কিন্তু সেটা রাজধানী আন্তানানারিভো থেকে শুরু হয়ে শত কিলোমিটারের মতো গিয়ে কাঁচা হয়ে গেছে। ভূ–প্রাকৃতিকভাবে মাদাগাস্কারের মাঝের অংশ পাহাড়ি। জনবসতি বা থাকা যাবে, এমন জায়গা পাওয়াও হবে দুরূহ। দিনপ্রতি ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যাওয়ার পরিকল্পনা করি। পাহাড়ি রাস্তায় সেটা সম্ভব হবে না। আর মাঝ দিয়ে এগোলে প্রতিদিন যে দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হবে, সে দূরত্বে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না। মাঝের দিকে যাওয়া যাবে না। খুঁজে পেতে দেখা গেল, রাজধানী থেকে সমুদ্রতীরবর্তী রাস্তা দিয়ে ৪৫০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা পাওয়া যাবে। এরপর শুরু হবে কাঁচা রাস্তা। এর থেকে বেশি আর কোনো দিকেই পাওয়া গেল না। তাই এই পথকেই বেছে নেওয়া হলো। আন্তানানারিভো বা তানা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে।

মাদাগাস্কারে পথে

প্রস্তুতির সময় কাকতালীয়ভাবে লরেট ম্যানদেরসিলহাটরা নামের এক মালাগাছি ভদ্রলোককে পেয়ে গেলাম। ভদ্রলোক তখন ঢাকায়ই থাকতেন। অদ্ভুত কারণে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রসুনের আচার তাঁর খুব প্রিয়। ই–মেইলের মাধ্যমে প্রথম যোগাযোগে যখন জানলাম, তিনি মাদাগাস্কারের নাগরিক, ঢাকায়ই আছেন, তখন মনে হলো, এর চেয়ে বড় কোনো উপহার আমাদের জন্য হতে পারে না। দেখা করা হলো। পরিচয়ের সময় তাঁর নামটা উচ্চারণ করতে পারলাম না। নিজেই বলে দিলেন, তাঁর শর্ট নেম লোলো। যাক বাবা! অন্তত একটা নামে তো ডাকা যাবে।

লোলো এনজিওকর্মী। কাজের সূত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকেছেন। বাংলাদেশেও সে কারণেই আছেন। আমরা ঠিক কী করতে চাইছি, তাঁকে বোঝাতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। দুই সপ্তাহ মাদাগাস্কার কেন, কোনো দেশের জন্যই যথেষ্ট নয়। আর আমরাও কোনো বিশাল অভিযানের পরিকল্পনা করিনি। তেমন আগ্রহও আমাদের ছিল না। আমাদের রাস্তার পরিকল্পনা তাঁর সঙ্গেও মিলে গেল। এদিকেই ছোট শহর বেশি পড়বে। মাদাগাস্কারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর তমাসিনাও এ পথেই। তমাসিনায় সমুদ্রবন্দর আছে। তাই সে অবধি রাস্তা সবচেয়ে ভালো। পুরোটাই পাকা। এসবও বললেন লোলো।

আগেই জেনেছি, মাদাগাস্কারে যেতে আমাদের ভিসা লাগবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে বলেও জানতে পারলাম না। যেসব দেশে সচরাচর বাংলাদেশিদের যাতায়াত কম, সেসব দেশে ভ্রমণের খরচও তুলনামূলক বেশি হয়। তাই আমাদের বের করার চেষ্টা ছিল, কোন পথে গেলে ভাড়া কম পড়বে। উপায় যে অনেক আছে, তা-ও নয়। পাখিবিশারদ ইনাম আল হক গিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্য হয়ে। তাঁর সঙ্গে আলাপে ভাড়াটাও জানতে পেরেছিলাম। আমাদের জন্য একটু কঠিন হয়ে যাবে। যদিও এই পথেই কম সময় লাগবে, কিন্তু ভাড়া বেশি। ঠিক হলো, লোলোর বাতলে দেওয়া পথে ভারতের মুম্বাই হয়ে কেনিয়ার নাইরোবির পথ ধরা হবে। নাইরোবিতে অল্পক্ষণের ট্রানজিট। সেখান থেকে আন্তানানারিভো। এই হলো পরিকল্পনা। খরচার দিক থেকে নাগালের মধ্যেই। ভিসা নিতে হবে শুধু ভারতের। সেটা কঠিন কিছু নয়।

দলে এবার চারজন। সালমা আপা, শামিমা আপা, আমি আর চঞ্চল। ওনাদের সঙ্গে আগেও অনেক জায়গায় সাইকেল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দল হিসেবে বেশ শক্তই। দুটো ট্যান্ডেম। একটার রং লাল, আরেকটা সবুজ। রং ছাড়া ছোটখাটো কিছু তফাত থাকলেও বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই দুই সাইকেলে।

সাইকেল দুটো যতটা সম্ভব সারিয়ে নেওয়া হলো। অবশ্য বিশেষ কিছু যে করা গেল, তা-ও নয়। কারণ, এই মাপের সাইকেলের ব্যবহার বাংলাদেশে একেবারেই কম। তাই নিজের বুদ্ধি–বিবেচনার ওপরই নির্ভর করতে হবে, যদি কোনো বিপদ ঘটে। বাড়তি পার্টস নেওয়া হলো। এসব বহনের জন্য দারুণ একটা বাক্সও পাওয়া গেল।

লটবহর ছোট নয় একদম। দুটো সাইকেলের ওজনই ৪০ কেজির আশপাশে। তার সঙ্গে যোগ হবে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ক্যামেরা, ল্যাপটপ, এটা-সেটা। চারজনে মোট ৮০ কেজি ওজনের মালামাল বিনা খরচে নিতে পারা যাবে চেকইন লাগেজ হিসেবে। আর হাতে সাত কেজি করে ক্যারিঅন হিসেবে। তাই যে করেই হোক ৮০ কেজির বেশি মালামাল নেওয়া যাবে না। মনে হতে পারে, ৮০ কেজি তো অনেক। কিন্তু আসলে তা নয়। সাইকেলের জন্য বাড়তি যে পার্টস, টায়ার-টিউব, চেইন, প্যাডল নেওয়া হয়েছে, তারই ওজন ১৫ কেজি। একটু বাড়াবাড়ি তো বটেই। কিন্তু যদি কোনো বিপদ হয়ে যায়, ওই মুলুকের কোথায় আর পাওয়া যাবে।

(চলবে)