চূড়ায় থাকার সময়ই শুরু হলো তীব্র তুষারঝড়

পর্বতারোহণের মর্যাদাপূর্ণ একটি অভিযান ‘স্নো লেপার্ড চ্যালেঞ্জ’। এই অভিযান সম্পন্ন করতে তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে অবস্থিত পামির ও তিয়েন শান পর্বতশ্রেণির পাঁচটি সাত হাজার মিটারের শৃঙ্গে আরোহণ করতে হয়। রোমাঞ্চকর অভিযানটি শুরু করেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী সালেহীন আরশাদী ও ইমরান খান। তিন পর্বের এই অভিযানে প্রথম পর্বে অভিযাত্রীরা গেছেন কিরগিজস্তানের লেনিন শৃঙ্গ আরোহণে। সেখান থেকেই প্রথম আলো অনলাইনের জন্য নিয়মিত লিখছেন সালেহীন আরশাদী। আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব

আজকে আমাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ভোরের দিকেও বৃষ্টি থাকায় স্লিপিং ব্যাগের ওম থেকে বের হতে ইচ্ছে করেনি। এদিকে অভ্যাসমতো ঘুম ঠিকই ভেঙে গেল। শুয়ে শুয়ে তাই জর্জ স্কেলারের স্টোন অব সাইলেন্স বইটি পড়তে লাগলাম। আটটার দিকে বৃষ্টি থামতে পাশে মরার মতো শুয়ে থাকা অজিলকে (ইমরান খান) ডাকলাম। ওর কোনো সাড়াশব্দ নেই। আজকের দিনটি তাই অঘোষিত বিশ্রামের দিন ভেবে আমি আরেকবার ঘুম দিলাম। সকাল ১০টার দিকে অজিল আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলল, চল ভাই ইউহিন পিকে যাই। মেজাজ প্রচণ্ড রকম বিগড়ে গেল। সকালবেলা কোনো সাড়াশব্দ ছিল না, এখন আমি ঘুমানোতে তার আর সহ্য হচ্ছে না। একবার ভাবলাম বলে দিই, আজকে আর বের হতে ইচ্ছা করছে না। আজকে রেস্ট নিয়ে আগামীকাল যাব ইউহিন পিক। পরে আবার ভাবলাম ক্লাইম্বিংয়ের পর ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিলেই ভালো হবে। অবশেষে জামাকাপড় পরে এক কাপ কফি পান করে ইউহিন চূড়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলাম।

ইউহিন চূড়ায় দুই অভিযাত্রী

ইউহিন চূড়ার পথে লেনিন পিকের একেবারে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। এই পথ থেকে লেনিন পিকের হিমবাহটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ক্যাম্প ১ থেকে ক্যাম্প ২ যাওয়ার পথটি দেখে কিছুটা শিহরিত হয়ে উঠলাম। ঝুলে থাকা হিমবাহ, হিমবাহের মধ্যকার অজস্র ফাটল পেরিয়ে একটি আইসফল বা হিমপ্রপাতও আছে, ভয়ংকর দেখতে এই পুরো পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। ঘুরে ঘুরে একটি পর্বতের মাথায় উঠতেই দেখি অজিল ইশারায় ডাকছে। এখানেও চূড়ার মতো একটি জায়গা আছে। ওপরে হিমালয়ের ধাঁচে বিশাল একটি পাথরের স্তূপ বা কেয়ার্ন বানানো আছে। ম্যাপে দেখাচ্ছে চূড়াটির নাম হোম পিক, উচ্চতা ৪ হাজার ৭১৭ মিটার। এক ঘণ্টার মধ্যেই ৩ মিটার ক্লাইম্ব করে ফেলেছি দেখে ভালোই লাগল। যদিও পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল আজকে তো সঙ্গে ব্যাকপ্যাক নেই, থাকলে বোঝা যেত কত ধানে কত চাল।

এরপরের ক্লাইম্বটি খুবই সম্মুখগামী ছিল। আর কোনো নামানামি নেই, একবারে খাড়া ঢাল ধরে চড়তে থাকো। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আমরা হাজির হলাম ইউহিন পিকের বরফে ঢাকা চূড়ার ঠিক নিচে। এদিকে আবহাওয়া দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেই আমরা চূড়ায় গিয়ে হাজির হলাম। আমাদের অল্টিমিটার দেখাচ্ছিল, চূড়ার উচ্চতা ৫ হাজার ১০৩ মিটার। চূড়ায় থাকার সময়ই তীব্র তুষারঝড় শুরু হলো। দুর্গম পরিস্থিতির মধ্যেই পৃথিবীর ছাদে অবস্থিত কোনো পর্বতে এটি আমাদের প্রথম আরোহণ। বাংলাদেশ থেকেও পামিরে এটিই প্রথম কোনো আরোহণ হলো। চিনির গুঁড়ার মতো শক্ত তুষার নাকে মুখে লাগছিল। আর সময়ক্ষেপণ না করে ঢাল বেয়ে আমরা দ্রুত নেমে গেলাম। একটানা দৌড়ে সোজা তাঁবুর ভেতর।

আগামীকাল আমাদের বিশ্রামের দিন। পরশু সবকিছু ঠিক থাকলে আমরা ক্যাম্প ১ থেকে ক্যাম্প ২-এর পথে রওনা হব।

৫ আগস্ট ২০২৩