শ্রীলঙ্কার যে ১৬টি পবিত্র জায়গাকে ‘ষোলোসমাস্তানা’ বলা হয়, এটি তার মধ্যে অন্যতম

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন একাদশ পর্ব।

এমন পাহাড়ি পথেই আজ হাঁটতে হয়েছে

একাদশ দিন: গুরুওয়েলা থেকে মাহিয়ানগানায়া। দূরত্ব: ৩৯.৪৪ কিলোমিটার

দিনটা শুরু হলো পাহাড়ের গায়ে-কাঁধে জমে থাকা মেঘ দেখে। পথের বাঁয়েই বেশ উঁচু উঁচু সব পাহাড়। গতকালই আমরা প্রবেশ করেছি পাহাড়ি উপত্যকার পথে। পাহাড় দেখার লোভেই অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের রাস্তার বদলে এই পথ বেছে নেওয়া। আর পাহাড়ের রূপ সব সময় দূর থেকেই সুন্দর। দূর থেকেই ঠিকঠাক এর কাঠামো আর সৌন্দর্য বোঝা যায়। আরোহণে অবশ্য অন্য আনন্দ আছে। নিজের সামর্থ্যকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দেওয়ার মতো আনন্দ আর কিসে আছে? আর সেটা পেরিয়ে যাওয়ার আনন্দের সঙ্গে জাগতিক কিছুর মিল খুঁজে পাওয়াটাই দুরূহ।

সকালের নাশতা

পথচলতি নিজেরা কত কিছু নিয়ে আলোচনা করি। জুমন ভাই আর আমার পছন্দের মধ্যে সাদৃশ্য থাকায় কথা বলার বিষয়েরও অভাব নেই। রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, অ্যাডভেঞ্চার কিংবা নির্বাসনে গেলে কোন পাঁচটা বই সঙ্গে নেব গোছের আলোচনা হামেশাই হচ্ছে। পথচলার কষ্ট এসব আলোচনা অনেকটুকুই লাঘব করে। আজ পথে বেশ টিয়া আর মাছরাঙা চোখে পড়ছে। সঙ্গে লালমাটিতে শেকড় ছড়ানো প্রচুর একাশিয়াগাছ। রাস্তার একপাশে ইলেকট্রিক বেড়া। মূলত হাতিকে বাঁচাতেই বানানো হয়েছে বেড়াগুলো। এক জায়গায় এসে রাস্তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। বি-৩১২ ছেড়ে বি-২৭৪–তে পথচলা। রাস্তা এবার উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকাও। পথে পড়ল একটা ভূমিধসপ্রবণ রাস্তা। আরেকটু এগিয়ে সামনে সরীসৃপের মতো গা এলিয়ে আছে ভীমদর্শন এক চড়াই। চড়াইয়ে মাথার ব্যান্ডের মতো সূক্ষ্ম সব বাঁক।

টালির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ময়ূর

মোরাগাহাউলপাথাতে প্রচুর হোটেল। চড়াই শেষে পাহাড়ি রাস্তায় বেশ ফুরফুরে লাগছে হাঁটতে। কিছুটা এগিয়ে উইলগামুওয়া। আরও সামনে এগোতেই হেট্টিপোলা নামক বড় জনপদ। খুব সুন্দর একটা খাল পড়ল। আজও কয়েকটা ময়ূর চোখে পড়ল খেতে। হাঁটতে হাঁটতে একটু অলস দৃষ্টি মেলে চারপাশে তাকালে কত কিছুই যে দেখা যায়! অবশ্য সেই দেখায় মনটাও থাকতে হয়। চোখ, কান আর মন, দেখে তিনজন! আমাকে আবার দিন শেষে লিখতেও হয়। মনের সঙ্গে তখন সঙ্গী হিসেবে নিতে হয় কালি আর কলমকে। অবশ্য আজকাল মোবাইল, কি–প্যাড আর মন, লেখে তিনে মিলে!

১২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সকালের নাশতার জন্য থামা। লেভারি নামক নাশতা পাতে পড়ল। রাইস নুডলস দিয়ে এর বহিরাংশ বানানো হয় আর ভেতরে থাকে নারকেল ও গুড়ের পুর। ওয়ানারাওয়া থেকে বি-২৭৪ সড়ক ছেড়ে বি-৫৭৭ ধরে পথচলা। এই রাস্তা আগের চেয়ে আরও ছোট। টুকটুক আর মোটরসাইকেল চলে শুধু। বাঁয়ে হাঁটুপানির বিশাল এক জলাশয়। আর জলাশয় আলোকিত করে আছে শুভ্র সব বক। এই রাস্তার স্থানীয় নাম নিপ্পন রোড। শেষ মাথায় নিপ্পন উইলগামুয়া বা সাকুরা ব্রিজ। নাম থেকেই এর জাপানি সংযোগ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সাইনবোর্ড দেখে সেটা আরও পোক্ত হলো। জাপান এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে বন্ধুত্ব আর পারস্পরিক সহযোগিতার নিদর্শনস্বরূপ এই সেতু নির্মিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে দীর্ঘ নদী মহাওয়েলি গঙ্গার ওপরে এটি বানানো হয়েছে। এই নদীর নামে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত আছে। মিনিস্ট্রি অব মহাওয়েলি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের এই মন্ত্রণালয় দ্বীপরাষ্ট্রটির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বৃহৎ জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এই নদীকে ঘিরেই। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, শ্রীলঙ্কার শুষ্ক অঞ্চলগুলোকে চাষ উপযোগী করার জন্য সেচ প্রকল্প এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের মতো মহাযজ্ঞ চলে এই নদীকে কেন্দ্র করে। এই নদীর খাত বেশ প্রশস্ত। বুকে অল্প কিছু বালুচর নিয়ে এগিয়েছে মোহনার দিকে। সেতু পেরিয়ে নতুন রাজ্য উভা প্রভিন্সে পা রাখলাম। হাঁটতে হাঁটতে জুমন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি তোমার পথের একদিকে হাতি আর অন্যদিকে চিতাবাঘ থাকে, তুমি কোন দিকে যাবা?’

দূর থেকে দেখা বিকেলের পাহাড়

‘অবশ্যই হাতির দিকে, এরা তো শাকাহারী,’ আমার জবাব!

অল্প এগিয়ে আরও ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। রাস্তার নাম সি-৬২৯। এদিকে বাড়িঘরের ঘনত্ব একেবারেই পাতলা। রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে সরীসৃপের সরসর করে সরে যাওয়ার শব্দ আসে মাঝেমধ্যেই। পথে একটা বাজারের শেষ মাথায় দোকান দেখে জুমন ভাই দূর থেকেই ওখানে চা খাওয়ার ইচ্ছের কথা জানালেন। গিয়ে দেখা গেল ওটা একটা লটারির দোকান! মজার ব্যাপার হলো, এত বড় একটা বাজারে কোনো দোকানে একটা সাইনবোর্ডও নেই। জুমন ভাই এবার একটা যাত্রীছাউনি দেখে থামার কথা বললেন। ওখানে বসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি। আধা ঘণ্টার বেশি সময় ওখানেই কেটে গেল।

আবার হাঁটা শুরু করতেই একটা পরিত্যক্ত টালির ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক ময়ূরকে পেলাম। খানিক পরে রাস্তার ধারের জলাশয়ে বিশাল এক গোসাপ। বাটালাভায়াতে পড়ল রুরাল আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল। শ্রীলঙ্কাজুড়েই আয়ুর্বেদের বেশ চল। পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে চায়ের জন্য থামতেই আবার বৃষ্টি। গায়ে পঞ্চো আর ব্যাকপ্যাকের গায়ে রেইনকাভার চাপিয়ে আবার চলা। এর আগে জুতা খুলে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে নিতেও ভুললাম না। এই পদব্রজ ভ্রমণে এবারই প্রথম পায়ে স্যান্ডেল পরলাম!

ছোটবেলার কুকুর বিতাড়ক মন্ত্র ‘আম, জাম, কুত্তা থাম’ বলেও কুকুরের ঘেউ ঘেউ থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি সারমেয়রা এই মন্ত্রের মর্মার্থ বুঝে ছোটবেলায় বার কয়েক থেমে গেলেও শ্রীলঙ্কান কুকুরেরা এমন এক অব্যর্থ মন্ত্রে কর্ণপাত করল না! টানা পা চালিয়ে আলুত্থারামা। ২০ কিলোমিটারের পর থেকে জুমন ভাইয়ের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। তার বাঁ পায়ের আর্চ বা বাঁকানো অংশের নিচে খানিকটা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। বৃষ্টির খপ্পরে পড়ে পায়ে স্যান্ডেল গলানোতে সেটা আরও প্রকট হয়েছে।

মাহিয়ানগানায়া শহরের ক্লক টাওয়ার

এখান থেকে বাথালায়ায়া জংশনে পৌঁছে পেলাম ‘সান্দু কেক অ্যান্ড লাভার আইটেম’ নামক দোকান। জগতের সবাই তো কোনো না কোনোভাবে লাভার! এই জংশন থেকে সোজা রাস্তাই নিয়ে যাবে আমাদের আজকের গন্তব্য মাহিয়ানগানায়াতে। শ্রীলঙ্কানদের মুখে শুনেছি, গৌতম বুদ্ধ শ্রীলঙ্কা এসেছিলেন বারতিনেক। আলোকত্ব প্রাপ্তির প্রথম বছরেই শ্রীলঙ্কাতে পা রাখেন তিনি। সেবার তিনি এসেছিলেন এই মাহিয়ানগানায়াতেই। এখানের রাজমহা বিহারে সংরক্ষিত আছে বুদ্ধদেবের চুলের অবশেষ। অবশ্য সেটির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে একে একে অনেকগুলো চৈত্য। শ্রীলঙ্কার যে ১৬টি পবিত্র জায়গাকে ‘ষোলোসমাস্তানা’ বলা হয়, এটি তার মধ্যে অন্যতম। মাহিয়ানগানায়া বাদে শ্রীলঙ্কার নাগাদ্বীপ ও কেলানিয়াতে পা রেখেছিলেন ভগবান তথাগত।

এ দিকের রাস্তা বেশ প্রশস্ত। একটু এগিয়ে আয়ুর্বেদ রিসার্চ হাসপাতাল পড়ল। রাস্তার এক জায়গায় ময়ূর পারাপারের করিডর পেলাম। সব ময়ূর ওই একটা অংশ দিয়েই রাস্তা পেরোচ্ছে। রাস্তার ধারের বাড়িগুলোতে জবার ঝাড় বাড়ির পাঁচিল টপকে পথিকের গায়ের ওপর এসে পড়ছে। পুরো দিন মেঘ ছিল পাহাড়ের কাঁধে আর গায়ে। এই শেষ বিকেলে সবুজ পাহাড়ের সারির পাদদেশে জমেছে মেঘ। দুপুরের খাবার খেলাম প্রায় বিকেলে। খাওয়ার পরে আমাদের গতিও বেড়ে গেল। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় স্যান্ডেল খুলে আবার জুতা গলানোতে জুমন ভাইও বেশ স্বস্তিতে।

আগের কয়েক দিনে খুব সুদৃশ্য কিছু যাত্রীছাউনি দেখেছি। আজকে বেশির ভাগ যাত্রীপ্রতীক্ষালয় ক্যামোফ্লেজ রঙের। আর প্রতিটা যাত্রীছাউনিই কোনো না কোনো সেনাসদস্যকে উৎসর্গ করা। ভেতরে ওই সেনাসদস্যের ছবিও রাখা আছে। সবকিছু এক মাপের, এক ধাঁচের হওয়াটা আমার কাছে বড় একঘেঁয়ে লাগে। ধীরপায়ে এগোচ্ছি মাহিয়ানগানায়া শহরের দিকে। রাস্তায় অসংখ্য মাছের দোকান। খোদ শ্রীলঙ্কার উপকূল অঞ্চলেও এত মাছের পসরা দেখিনি। সরোবরা লেক আছে বলেই খুব সম্ভবত এত মাছ। সরোবরা নামটা শুনলেই সরোবরের প্রশান্তি পাওয়া যায়। শহরের ক্লক টাওয়ারের বিপরীতেই বিশাল সমাধি বুদ্ধমূর্তি। মাত্রই বছর দুয়েক আগে স্থাপন করা হয়েছে। বুদ্ধের সেই চিরায়ত ধ্যানী ও মৌনী ভঙ্গি। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে উঠে পড়লাম রাতের আবাস বিমনা গেস্টহাউসে।

আগের পর্ব