শহরটার নাম মরামাঙ্গা

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব

সাইকেল নিয়ে পথে নামার আগে

মনে হলো একটা গাড়ির আওয়াজ। বিপদ নাকি রক্ষাকর্তা? সবাই উদ্‌গ্রীব। গাড়ি এল, একজন ফরাসি আর দুজন স্থানীয় মানুষ গাড়িতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই রাতের বেলা সাইকেল নিয়ে আমরা পথ ভুল করেছি।

হোটেলের নম্বরে ফোন করলাম। কেউ ধরল না। অস্থির লাগছিল। আবার ট্রাই করলাম। এবার পাওয়া গেল, অপর পাশ থেকে এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠ। তিনি বুঝতে পেরেছেন পথ ভুল করে কোথায় আমরা। এখন রাস্তায় সাইকেল চালানো নিরাপদ নয়। গাড়ি পাঠাবেন, আমাদের মূল সড়কের দিকে এগিয়ে আসতে বললেন।

সংযোগস্থলে গাড়িটা অপেক্ষায় ছিল। সেই গাড়ি কখনো আমাদের সামনে কখনো পেছন থেকে আলো দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল আরও পাঁচ কিলোমিটার। প্রায় ৯টার সময় রাস্তার সঙ্গে লাগানো গাছগাছালিতে ভরা মানদ্রাকা পার্ক হোটেলে চলে এলাম।

বেরিয়ে পড়ার আগে

রাতে দেরি করে ফেলায় জায়গাটা দেখা হয়নি। সাড়ে ছয়টায় খাবারের কথা বলা আছে। সাইকেল সাজিয়ে একেবারে রেডি। খেয়ে বেরিয়ে যাব। হোটেলের ভদ্রমহিলা বললেন, লেমুর দেখতে চাই কি না। জানালাম, অবশ্যই চাই। মাদাগাস্কার বললে সারা দুনিয়ার মানুষ যা বুঝবে, তা হলো এই লেমুর। বিশেষত, ‘মাদাগাস্কার’ সিনেমার জন্য এর পরিচিতি ব্যাপক।

মাদাগাস্কারের লেমুর

লেমুর দেখে সকালের খাওয়া হলো ফরাসি কায়দায়। ন্যাপকিন জড়িয়ে ব্রেড বাটার অমলেট। সঙ্গে ফলের জুস। তারপর বেরিয়ে পড়লাম। সুন্দর আর মনোরম পরিবেশ। রাতে একটা কাঠের ব্রিজ টপকে এসেছিলাম। এখন দেখা গেল, তার নিচে বহমান নদী।

সিঁথির মতো সরু নদীটা আমাদের সঙ্গী হলো। বাঁ দিকে বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। কলকল শব্দ পাওয়া যায় খানিক বাদে বাদে। রাস্তা এখানে দারুণ। ওঠানামা আছে, তবে গাছগাছালিতে ভরা। মন খুলে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা একসঙ্গেই। নিকট দূরত্বে একটা স্থাপনা। মানদ্রাকার মতোই।

‘ভাইয়া!’ চঞ্চলের হাঁক শুনতে পেলাম।

‘আবার কি?’

‘কটকট একটা শব্দ আসছে সাইকেল থেকে।’

‘আচ্ছা, সামনে গিয়ে থামি।’

বয়ে চলেছে ছোট নদী

রাস্তা থেকে বাঁয়ে ফাঁকা একটা জায়গা। পার্কিং লট। নদী একটু নিচে। শণের বেড়া দেওয়া কয়েকটা ঘর। ফাঁকা। থেমে চঞ্চলের সাইকেল দেখি সামনের চাকার স্পোক কেটে গেছে। তাই শব্দ আসছে।

আটটাও বাজেনি। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে আজ! চলে গেল ৩০ মিনিট।

নামা রাস্তা। একদিক দিয়ে ভালো, পেডেল মারতে হচ্ছে না। কিন্তু ব্রেক চেপে ধরে রাখতে হয় ক্রমাগত। একসঙ্গেই চালানো যাচ্ছে আজ। মাঝে মাঝে উঠতে হয়, তবে নামার মতো নয়। ওরাও চালাতে পারছে।

এমনই এক ঢালে নামার সময় শব্দ করে আমাদের সাইকেলের সামনের চাকা ফেটে গেল। ব্রেক ধরে থাকার কারণে গরম হয়ে টিউব ফেঁসে গেছে। চঞ্চলদের এগিয়ে যেতে বললাম। আমরা ধরে ফেলতে পারব। নদীর পানিতে চাকা দুটো ভিজিয়ে ঠান্ডা করে নিলাম। তারপর ঠিক করে নিলাম।

মরামাঙ্গা শহরে যাওয়ার পথে

আবার চালানো শুরুর পর মিনিট কুড়ি পরে দেখা হলো চঞ্চলদের সঙ্গে। এখানে সাইকেলের এক মিস্ত্রি পেয়েছে তারা। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, সাইকেলে যদি আর কোনো সমস্যা পাওয়া যায়, তো ঠিক করে নেওয়া। বুদ্ধিটা ভালো। টায়ার পাল্টাতে বললাম। আমাদের পেছনের চাকার টায়ারটা ক্ষয় হয়েছে বেশি। ওটা সামনের চাকার সঙ্গে বদল করে নিলাম। মিস্ত্রি ছিল যেহেতু, দুই সাইকেলের কাজ দ্রুত হয়ে গেল।

সারাইখানার আশপাশে আট-দশটা ঘর। কয়েকটা বাচ্চা ঘুরে ঘুরে দেখছে আমাদের। কাছে আসছে না। সঙ্গে চকলেট-জাতীয় কিছু থাকলে ভালো হতো। ভাব জমানো যেত। তাদের গায়ের কাপড় ময়লা, জোড়াতালি দেওয়া। বেশির ভাগের পা খালি। উন্নয়নের জোয়ার এদিকে একেবারেই আসেনি। এখনো কোনো স্কুল চোখে এল না।

মিষ্টি হাসি দিয়ে মিস্ত্রি যত্ন নিয়ে কাজ করছে। পরম মমতার ছোঁয়া পড়ছে সাইকেলে। মিস্ত্রির মাথায় তিলে ধরা ক্যাপ। কোনোকালে সাদা ছিল তার নিদর্শন এখনো আছে। গায়ে আলখেল্লার মতো ওভারসাইজ একটা জ্যাকেট। পায়ে সেলাইয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় চপ্পল। নখগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। গাত্রবর্ণ মিশকালো নয়। বরং রোদে পুড়ে যাওয়া রং। আমাদের সাহেব ভাবছে না। চোখমুখের ভাষায় তা আমি ধরতে পারছি। তাই হয়তো মমতা ঢেলে দিচ্ছে সাইকেলে। আমার খুব ভালো লাগছে। সাইকেলের সমস্যার কথা কর্পূরের মতো উবে গেছে মন থেকে। আরও পাংচার হোক, ছিঁড়ে-ফেটে চৌচির হয়ে যাক চাকা! এমন মানুষের সঙ্গে যেন আবার দেখা হয়। দেশ দেখার আবার কি আছে, যদি মানুষ দেখা না হয়?

পথের পাশের সারাইখানায়

ভাবনায় ইতি দিয়ে খরচা মিটিয়ে চলে এলাম। হাতলে লাগানো আয়নায় দেখলাম লোকটা টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে কি কম দেওয়া হলো? নাকি আমাদেরও তার ভালো লেগেছে। দ্বিধা নিয়েই দ্রুত পা চালিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলাম।

১১টা বাজে তখন। ব্রেক নিয়েছি। নাশতা করছিলাম। একটা গাড়ি আমাদের সামনে এসে থামল। এখানে কেউ নামবে তার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। যা ভাবছি তা-ই। সালমা আপা নামলেন। এবার সমস্যা জটিল। চেইন ছিঁড়ে গেছে। এটা সমস্যাই। আমাদের ব্যাগে বাড়তি যে চেইনটা ছিল, তা নিয়ে গাড়িতে মিনিট খানেক যেতেই দেখি চঞ্চল সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নামতে নামতে দেখলাম একজন স্থানীয় চেইন ঠিক করার চেষ্টা করছে। দুজনের কেউ কারও ভাষা না জানলেও কী করতে হবে বুঝে গেছে দুজনই। আমি গিয়ে দেখলাম, সমস্যা তত খারাপ নয়। আমাদের চেইনগুলোর দুই মাথা জোড়া দেওয়া থাকে একধরনের ক্লিপ দিয়ে। দ্রুত সারিয়ে নেওয়ার জন্য সাইকেলের চেইনে যে কোয়া থাকে, ঠিক হুবহু একই রকম দেখতে এই ক্লিপ দিয়ে দুই প্রান্ত আটকে রাখা যায়। এই পদ্ধতি সুদূর মাদাগাস্কার কেন, খোদ ঢাকা শহরের কোনো দুঁদে সাইকেল মেকানিকও জানবে না।

মরামাঙ্গা শহরে

ক্লিপ জোড়া খুলে গেছে। হারিয়ে যায়নি, এই ভাগ্য। শুধু চাপ দিয়ে লাগিয়ে দিতে হলো। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। হয়ে গেল। আমি চঞ্চলকে পেছনে বসিয়ে চালিয়ে চলে এলাম, যেখানে অপেক্ষা করছিলাম।

বিকেল পাঁচটার কাছাকাছি সময়ে মরামাঙ্গা নামের শহরে প্রবেশ করলাম। মহাসড়কের দুই ধারে দোকানপাট। দু-একটা রাস্তা মূল রাস্তা থেকে ডানে-বাঁয়ে চলে গেছে। আমরা সোজা এগিয়ে যাচ্ছি। এ সড়কের ওপর আমাদের হোটেল পড়বে। পাওয়া গেল সাইনটা। দোতলা থেকে ঝুলে আছে ফুট দুয়েক দৈর্ঘ্যের বাতিওয়ালা সাইনেজ। বাঁ দিকে ঢুকেই প্রথমে রিজার্ভেশন ডেস্ক। আনুষ্ঠানিকতা শেষে চলে গেলাম রুমে।

(চলবে)