নেপালে অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্প (এবিসি) ট্রেক করার আগে দুই মাস ধরে আমরা খালি পরিকল্পনাই করেছি। ট্রেক রুট, আবহাওয়া, খাবার, বাসস্থান, প্রয়োজনীয় গিয়ার, ওষুধ ও খরচ এবং সতর্কতা নিয়ে গবেষণা করেছি।
বিস্তর গবেষণার পর যা যা কিনেছি, তা থেকে অভিজ্ঞতা হলো, বাংলাদেশ থেকে ট্রেকিংসামগ্রী কেনা ভালো। কারণ, নেপালে এসব বেশ ব্যয়বহুল।
নেপালে অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্প (এবিসি) ট্রেক করার আগে দুই মাস ধরে আমরা খালি পরিকল্পনাই করেছি। ট্রেক রুট, আবহাওয়া, খাবার, বাসস্থান, প্রয়োজনীয় গিয়ার, ওষুধ ও খরচ এবং সতর্কতা নিয়ে গবেষণা করেছি।
রওনা হওয়ার এক মাস আগে হোটেল এবং বিমানের টিকিট বুক করি। সেই সঙ্গে ভালো মানের প্রয়োজনীয় সামগ্রীও খুঁজতে শুরু করি। বিস্তর গবেষণার পর যা যা কিনেছি, তা থেকে অভিজ্ঞতা হলো, বাংলাদেশ থেকে ট্রেকিংসামগ্রী কেনা ভালো। কারণ, নেপালে এসব বেশ ব্যয়বহুল।
১১ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডুতে পৌঁছাই। সেখান থেকে পোখারা যাওয়ার জন্য একটি রাতের বাসে চড়েছিলাম, জনপ্রতি খরচ হয়েছিল ১৬০০ নেপালি রুপি। আমাদের ট্রেকিং শুরু হয় ১৩ সেপ্টেম্বর। শেষ হয় ১৯ তারিখ।
পরিবহন আর পোর্টারের ব্যবস্থা করেছিলেন আমাদেরই হোটেল ম্যানেজার বিকাশ বিশ্বকর্মা। পুরো ট্রেকের জন্য পোর্টার পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন ২০ হাজার রুপি। আমরা একটি ৪ চাকার জিপ গাড়ি ভাড়া করেছিলাম, যার যাতায়াত খরচ পড়েছিল ১৬ হাজার রুপি।
প্রথম দিনে গাড়ি আমাদের ঝিনু নামক একটি স্থানে নামিয়ে দিয়েছিল। এখান থেকে আমাদের ট্রেক শুরু হয়েছিল। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ঝিনু থেকে চোমরং যাওয়ার পথটিকে বলা হয় সবচেয়ে কঠিন, কারণ, সিঁড়ির সংখ্যা অনেক বেশি আর রাস্তাও অনেক খাড়া।
ট্রেকের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুটিও আমরা এখানেই অতিক্রম করেছি, তবে দুর্ভাগ্যবশত হট স্প্রিং আমরা মিস করি, আসলে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল আর হঠাৎ বৃষ্টিও শুরু হয়েছিল।
স্থানীয় যাঁরা আমাদের সঙ্গে হাঁটছিলেন, তাঁরা অবশ্য আমাদের অনেক উৎসাহিত করেছিলেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমরা চমরং (২১৭০ মি.) পৌঁছাই। ছোট একটি লজে ব্যক্তিগত বাথরুমসহ রুম বুক করি।
লজটি বেশ সুসজ্জিত, ওয়াইফাই, গরম ঝরনা এবং পরিষ্কার বিছানা আছে। রাতের খাবারের জন্য নেপালি থালি (ভাত, ডাল, সবজি এবং আচার ছিল) এবং ফ্রাইড রাইস নিয়েছিলাম। সকালের নাস্তায় দুধ–চা দিয়ে গুরুং (তিব্বতি রুটি) নিলাম।
চমরংয়ে সূর্যোদয় সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধকর। মাছাপুচরে এবং অন্নপূর্ণা রেঞ্জের অকল্পনীয় দৃশ্য ছিল।
দ্বিতীয় দিন আমরা আপার সিনুওয়ার (২৩৬০ মি.) উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। প্রথম দিনের তুলনায় এই ট্রেক ছিল বেশ সহজ। উজ্জ্বল সূর্যের উষ্ণতা, বন্ধুভাবাপন্ন স্থানীয় লোকজন এবং অনেক জলপ্রপাতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যায়।
পুরো ট্রেক রুটে খাবারের তালিকা এক থাকলেও যত ওপরে উঠতে থাকবেন, ততই বাড়তে থাকবে দাম। এখান থেকে আপনি কোনো ব্যক্তিগত বাথরুম পাবেন না।
আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রাতরাশের জন্য প্যানকেক এবং গুরুং নিলাম।
তৃতীয় দিনে আমরা ৩টি গ্রাম পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। গ্রামগুলো হলো ব্যাম্বু (২৩১০ মি.), ডোভান (২৬০০ মি.) এবং হিমালয় (২৬০০ মি.)। এই পথে গহিন বনের মধ্য দিয়ে একটি রোমাঞ্চকর ট্রেকিং ছিল। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।
এই পথ দিয়ে হাঁটার সময় আমরা সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত দেখতে পেয়েছি। আমরা রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া এবং বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে হিমালয়ের একটি স্থানীয় লজে পৌঁছেছিলাম। এখান থেকে আবহাওয়া শীতল হতে শুরু করে, আমরা পাহাড়ের হিমেল বাতাস অনুভব করতে থাকি।
দিনের শুরুটি প্রথমে মেঘলা ছিল কিন্তু বেলা বাড়লে রোদ উঠতে শুরু করে। বেলা একটা থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমরা বৃষ্টির মুখোমুখি হয়েছি।
চতুর্থ দিনে আমরা দেউরালির দিকে রওনা দিলাম। দেউরালি যাওয়ার পথটি ঝুঁকিপূর্ণ। একাধিক জলপ্রপাতের দ্রুত প্রবাহিত স্রোত অতিক্রম করার জন্য বাঁশ দিয়ে কয়েকটি সেতু তৈরি করেছে স্থানীয় লোকজন।
পাথরের পথটি দেউরালি পর্যন্ত ৩২৩০ মি. উচ্চতায় নিয়ে যায়। প্রবল বৃষ্টিতে ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা দেউরালির একটি স্থানীয় লজে পৌঁছেছিলাম।
এখানের পরিবেশটা চমৎকার, সারা বিশ্ব থেকে আসা সহট্রেকারদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পেরেছিলাম। অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানের মাধ্যমে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পঞ্চম দিন আমরা মাছাপুচরে বেজ ক্যাম্প (এমবিসি) পৌঁছানোর উদ্দেশে বের হই। এখান থেকে ট্রেক রুট আগের তুলনায় বেশ সহজ কিন্তু খুব দ্রুত উচ্চতা অর্জন করার কারণে চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। মোদী নদী পেরিয়ে যেদিকে তাকাই সেদিকেই জলপ্রপাত।
আমরা যখন এমবিসি (৩৭০০মি.) পৌঁছলাম, তখন মাছাপুচরে (ফিশটেল পর্বত নামেও পরিচিত) তার অপূর্ব দৃশ্য দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাল। খুব কাছ থেকে মাছাপুচরের দৃশ্য অকল্পনীয় সুন্দর। লজে আমরা বাঙালি খাবার রান্না করেছিলাম।
সাধারণ বাঙালি খাবার—ডিমের তরকারি, ডাল, ভাত এবং আলুভর্তা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকেরা আমাদের রান্না করা বাঙ্গালি খাবার পছন্দ করেছিল। হঠাৎ মধ্যরাতে একটি হিমালয়ের চিতাবাঘ আমাদের লজের কাছে চলে আসে। তিনটি পোষা কুকুর ওদের তাড়িয়ে দেয়।
ষষ্ঠ দিন আমরা আমাদের শেষ গন্তব্য অন্নপূর্ণা বেজ ক্যাম্পের দিকে রওনা হলাম। পথটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য। বুনোফুল, মোদী নদী এবং উপত্যকার পথ দিয়ে আমরা হেঁটেছি। একপর্যায়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে আমরা মেঘের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি। অবশেষে আমরা এবিসি (৪১৩০মি.) পৌঁছাই।
সপ্তম দিনে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠি। মাছাপুচরে ও অন্নপূর্ণার শৃঙ্গের সৌন্দর্য দেখে সবাই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলো।
অন্নপূর্ণার বরফে ঢাকা চূড়া সূর্যোদয়ের সময় সোনালি রশ্মিতে জ্বলজ্বল করছিল। দৃশ্যটি অবিস্মরণীয়। আমাদের একজন গুরুতর এএমএস (একিউট মাইন্টেন সিকনেস)–এর শিকার হওয়ায় এবিসি থেকে আমরা হেলিকপ্টারে চড়ে পোখরায় ফিরে যাই।
দম্পতি হিসাবে প্রতিটি লজে খরচ ছিল প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার নেপালি রুপি (এমবিসি এবং এবিসিতে আরও বেশি)। তবে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের রাজকীয় দৃশ্য একবার দেখলে মনে হয়, পুরো যাত্রা সার্থক। প্রকৃতি এবং পাহাড় উপভোগ করে এমন যেকোনো ব্যক্তির জন্য এটি একটি আজীবনের অর্জন।