পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এয়ারপোর্টে হেলিকপ্টারে

৬৩ বছর বয়সে এসে হিমালয়ের প্রেমে পড়েন ইফতেখারুল ইসলাম। এভারেস্ট বেসক্যাম্প ভ্রমণ নিয়ে ২০২১ সালে লিখেছেন বই—‘যেখানে এভারেস্ট’। হিমালয়ের ডাকে এ বছরও গিয়েছেন গোকিও। গোকিও রির শীর্ষ থেকে দেখেছেন এভারেস্টসহ বিখ্যাত সব পর্বতশিখর। সে অভিযাত্রা নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আজ।

পুরো এভারেস্ট অঞ্চলটি সাগরমাথা জাতীয় উদ্যানের অংশ। সাগরমাথা আসলে মাউন্ট এভারেস্টেরই আরেক নাম। পাইনবন, নামচেবাজার, মাউন্ট এভারেস্ট, এভারেস্ট বেজক্যাম্প, অমা ধবলাম, লোৎসে ও নুপৎসে, গোকিও, বেশ কয়েকটি গিরিপথ, নদী ও হিমবাহ রয়েছে এই উদ্যানে। গোকিওতে ৪ হাজার ৭৫০ মিটার উচ্চতায় চারপাশের পাহাড় আর তুষারাবৃত উঁচু উঁচু পর্বতশিখরের মাঝখানে রয়েছে কয়েকটি লেক। শীতে সেসব লেকের পানি জমাট বেঁধে যায়। আবার এপ্রিলে গলতে শুরু করে লেকের বরফ। সেই মোহনীয় দৃশ্য দেখতে ইচ্ছে করে। ছেলেবেলায় পড়া ভ্রমণকাহিনির মানস সরোবর এখনো আমার চোখে স্বপ্নের মতো লেগে আছে। সেই স্বর্গ-সরোবর কবে দেখতে পাব জানি না। তবে এবার গোকিও লেকের জলেই আমার মনের তৃষ্ণা মেটাতে চাই। তা ছাড়া এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হিমবাহ গোজাম্পা গ্লেসিয়ার আছে এখানেই। গোকিও রির চূড়ায় উঠে দেখা যায় দূরের ও কাছের সব পর্বতশিখর। সবচেয়ে কাছে চো ওইউ পর্বত। শুনেছি, বিশেষ করে সূর্যোদয়ের সময় ওখান থেকে মাউন্ট এভারেস্টের অনেকখানি দেখা যায়। আর দেখা যায় পুমোরি, তাবুচে, চোলাৎসে ও থামশের্কুর মতো সব চেনা শিখর। কিন্তু গোকিও থেকে গোকিও রির শীর্ষে পৌঁছানো মানে অনেকখানি পর্বতারোহণ। এর উচ্চতা ৫ হাজার ৩৫৭ মিটার।

মেঘলা দিনে শূন্য পড়ে আছে লুকলার ছোট্ট বিমানবন্দর

পাহাড়ে ওঠার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। গতবার এভারেস্ট বেজক্যাম্পে (ইবিসি) যাওয়া ছাড়া ট্রেকিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। তবু এত উঁচুতে ওঠার কথা ভাবতে একটুও ভয় করে না। কারণ, এতে আছে অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি। বিশালতার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা। একা একা পর্বতশিখর আর মেঘ-পাহাড়ের লুকোচুরির দিকে তাকিয়ে থাকা।

লুকলা বিমানবন্দরে লেখক

অ্যামেজিং নেপাল ট্রেক অ্যান্ড এক্সপিডিশন-এর নির্মলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এই ট্রেক করব বলে স্থির করি। গাইড তেজ বাহাদুর আমাকে সমর্থন জানায়। ওর ধারণা, আর কিছুদিন পর এই ট্রেক, এই উচ্চতা আমার জন্য হয়তো আরও কঠিন হয়ে উঠবে। এবারই এটা সেরে ফেলা দরকার। গোকিও রির শীর্ষে উঠতে পারব কি না, পরে দেখা যাবে। আপাতত পৌঁছাতে হবে গোকিও পর্যন্ত।

ট্রেক শুরুর আগের দিন, অর্থাৎ ৫ মে বিকেলবেলা নির্মল ও তেজ আমাকে বুঝিয়ে বলেছে পুরো ট্রেকের কর্মসূচি। কোন দিন কতটা হাঁটা আর কবে কোথায় রাতযাপন। ট্রেকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস আগেই কেনা আছে, তারপরও ওই দিন সন্ধ্যায় কিছু কেনাকাটা সেরে নিতে হলো। ট্রেক শুরু করার জন্য ৬ মে সাড়ে ছয়টায় আমাদের কাঠমান্ডু থেকে লুকলা যাওয়ার কথা।

এখান থেকেই ট্রেকিং শুরু হয়

রাত থাকতেই উঠে তৈরি হয়ে নিই। সূর্যোদয়ের আগেই তেজ আর আমি থামেলের হোটেল ব্লু হরাইজন থেকে গাড়িতে করে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিই। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানি না। তেজ গাড়িতে উঠেই আমাকে জানায় যে আবহাওয়া ভালো না। আকাশে মেঘ জমেছে, যেকোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। এই আবহাওয়ায় অন্য সব ফ্লাইট হয়তো চলবে। কিন্তু লুকলার ফ্লাইট যাবে না। তেজ তার মুঠোফোনে আমাকে দেখায় লুকলা এয়ার স্ট্রিপের লাইভ দৃশ্য। সেখানে বাতাসে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘ ও কুয়াশায় চারদিকের সবকিছু ধূসর। এয়ার স্ট্রিপ বা রানওয়ে কিছুই দেখা যায় না।

মেঘের আড়াল থেকে আলো এসে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ে ও পাইনবনে

ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে পৌঁছে দেখি সীতা এয়ার আর তারা এয়ারের লুকলা ফ্লাইট বন্ধ। অন্য গন্তব্যে সব ফ্লাইট চলছে স্বাভাবিক সময়মতো। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। ভোর ছয়টা থেকে বসে আছি। আটটা বাজল, নয়টা বাজল, দশটা বাজল। নানা দেশ থেকে আসা বেশ কয়েকজন পরিব্রাজক ও ট্রেকার এয়ারপোর্টের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে-বসে আছেন। আমরা জানালা দিয়ে আকাশ দেখি। মাঝেমধ্যে মেঘ সরে যায়। হঠাৎ মনে হয় রোদ না উঠলেও দিনটা একটু পরিষ্কার হয়েছে। লুকলাতেও কি মেঘ কেটে গেছে? এয়ারপোর্টে কিছু চাঞ্চল্য দেখতে পাই। অবশেষে লুকলা যাওয়ার জন্য একটা ফ্লাইট ছাড়ল। পরের ফ্লাইটে আমার যাওয়ার কথা। কিন্তু তখনই আবার দেখি আকাশ একটু মেঘাচ্ছন্ন। কী হবে?

সাধারণত এই পথে অনেক হেলিকপ্টার চলে। তাতে ভাড়া বেশি। কিন্তু হঠাৎ শুনি বাড়তি টাকা ছাড়াই সীতা এয়ার আমাদের কয়েকজনের জন্য একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করছে। আমি কি যেতে রাজি? নিশ্চয়ই। কাল যে আবহাওয়া ভালো থাকবেই, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সুযোগ থাকলে আজই চলে যাব। পার্বত্য পথে প্রতিটি পদক্ষেপে অনিশ্চয়তা আছে। কিন্তু অন্য কারও মতামত বা পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ নেই। ঝুঁকি বিবেচনা করে নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

গোকিও রির পথে লেখক

হেলিকপ্টারে আরও দুজন বিদেশি ট্রেকার যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে তেজ আর আমার জন্য দুটো আসনের ব্যবস্থা হয়েছে। ভালোই তো। আগেরবার সীতা এয়ারের টুইন ওটার প্লেনে ১৬ জন যাত্রীর একজন হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এয়ারপোর্টে গিয়ে নামার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার হেলিকপ্টার, নতুন অভিজ্ঞতা।

বেলা ১১টার পর বাসে করে হেলিকপ্টারে ওঠার জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছাই। পাইলট তেজের বন্ধু। মনে হয় এই পথে যে যেই পেশায় থাকুক সবাই একে অপরের বন্ধু। তারা কথা বলে জানাল, প্লেনে এই ফ্লাইট ৩৫ মিনিটের হলেও হেলিকপ্টারে সময় লাগবে প্রায় এক ঘণ্টা। অনেকখানি উঁচুতে উঠতে হবে। তবে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের রাজ্যে পথ চিনে নিরাপদে লুকলা পৌঁছানো সহজ নয়। একটু ঘুরপথে গিয়ে পার্বত্য এক নদীর রেখা ধরে তার ঠিক ওপর দিয়ে উড়ে যাবেন পাইলট। মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়-পর্বতের গা ঘেঁষে চলার চেয়ে এটাই এখন সবচেয়ে নিরাপদ। হিমালয়ের অভিযাত্রী আমরা। আমাদের যাত্রার শুরুতেই অ্যাডভেঞ্চার জমে ওঠে।

ট্রেকিংয়ের প্রথম দিন থেকেই এরকম ঝুলন্ত সেতু পার হতে হয় বারবার

তেজ আর আমি ছাড়া এই হেলিকপ্টারে আরও দুজন যাত্রী। তাঁরা এসেছেন রাশিয়া থেকে। চারদিক ঝাপসা দেখালেও তাঁদের একজন বেশ কিছু ছবি তুলছেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখি মেঘে ঢাকা পাহাড়গুলোর ভেতর থেকে একটা-দুটো শিখর মেঘের ফাঁক দিয়ে একটু স্পষ্ট দেখা যায়। এর একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। তবে এ রকম আবহাওয়ায় আকাশপথটা বেশ বিপৎসংকুল লাগে। ইঞ্জিন আর পাখার শব্দে কানে তালা লেগে যায়। কিন্তু এই আকাশ চেনা বলে পাইলট বেশ আস্থার সঙ্গে আমাদের ছোট্ট ফড়িংটিকে উড়িয়ে নিয়ে চলেন। কিছুক্ষণ পর সামনের পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট একচিলতে বিমানবন্দর দেখতে পাই। তিনি হেলিকপ্টারটিকে মূল এয়ার স্ট্রিপ থেকে সামান্য বাঁয়ে নিয়ে নিরাপদে পাহাড়ঘেরা লুকলায় নামিয়ে দেন আমাদের।