অ্যালিট্র্যাস্কে মুজ শিকারের অভিজ্ঞতা

ঘুরতে গিয়ে এই বাড়িতেই ছিলেন লেখক
ছবি: ফরিদ ফারাবী

নর্থ সুইডেনের ছোট্ট গ্রাম অ্যালিট্র্যাস্কে এটা আমাদের দ্বিতীয় সফর। লেকের পাড়ের অদ্ভুত সুন্দর বাড়িটা আমাদের সুইডিশ বন্ধু ক্রিস্টোফারের গ্রামের বাড়ি। এই ধরনের বাড়িগুলোকে সুইডিশরা স্তুগা বা কেবিন বলে থাকে।

এবারের সফরে ক্রিস্টোফার আমাদের সঙ্গে নেই। তবে তার বাবা রোলফ খোঁজ রাখছেন নিয়মিত। যদিও এখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে থাকেন তিনি। সুইডিশ বসতবাড়ির অবস্থান বিবেচনায় অবশ্য খুব একটা দূরে থাকেন বলা যায় না।

এই পরিবারের প্রতিটা সদস্যেরই দ্রুততম সময়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ক্রিস্টোফারের সত্তরোর্ধ্ব বাবা রোলফ বা তাঁর মা গুন্নেলও ব্যতিক্রম নন। প্রতিবার তাঁদের দেখি আর উজ্জীবিত হই। হ্যাঁ, বয়স আসলেই একটা সংখ্যা!

সারা দিনের ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যার দিকে কফি হাতে বসে আছি। এমন সময় বিশাল ট্রেলার–সমেত গাড়ি নিয়ে হন্তদন্ত হাজির হলেন রোলফ চাচা, ‘জঙ্গলে নতুন অভিজ্ঞতা নিতে চাও? চলো।’

কী বৃত্তান্ত জানতে না চেয়ে ঠান্ডার যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম। আমাদের এত জানার দরকারই–বা কী! এতটুকু বুঝি যে এই পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কোথাও যাওয়ার সুযোগ মানেই নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চার।

গাড়িতে আমাদের নিয়ে জঙ্গল অভিমুখে ছুটলেন চাচা। টুকটাক গল্প করতে করতে জঙ্গলের কাছে একটা বাড়িতে এসে থামলেন। ট্রেলারে রবারের বিশাল একটা ট্রের মতো জিনিস তুললেন। আমিও হাত লাগালাম।

শিকারের জন্য যেতে হবে এই জঙ্গলে

তারপর জঙ্গলের রাস্তার একখানে এসে থামল গাড়ি। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিল ক্রিস্টোফারের বড় ভাই ক্রিস্তেরসহ আরও একজন। ক্রিস্তেরের সঙ্গে আগেরবারই পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গেই স্নোমোবিলে ঘুরেছিলাম। টুকটাক হাই-হ্যালো করতে করতেই ট্রেলার থেকে বিশাল সেই ট্রে নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা। সে জিনিস মাটিতে রেখে শেকল দিয়ে হুক আটকানো হলো চার চাকার এমন একটা বাইকের সঙ্গে, যা কিনা জঙ্গলের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলতে সমর্থ। এ ধরনের বাইক মরুভূমিতেও অনেককে চালাতে দেখা যায়। তবে সুইডেনে অনেকে অসমতল রাস্তায় চালানোর জন্য ব্যবহার করেন। রোলফ চাচা নিজের গাড়ি ছেড়ে বাইকে গিয়ে বসলেন। রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে ছুটল বাইক। হেডল্যাম্প লাগিয়ে আমরা বাকিরা কজন আগেই জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। আমাদের ফলো করে চাচা এগোতে লাগলেন। ইতিমধ্যেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গ্রামের আরও একজন।

জঙ্গলের এই দিকটায় কেবলই ঝোপঝাড় আর ছোট ছোট গাছ। সেই এবড়োখেবড়ো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটল বাইক, ট্রে–সমেত। অক্টোবরের এই সময়েই হাত–পা জমে যাওয়ার মতো ঠান্ডা পড়ে গেছে। এর মধ্যেই ছবি তুলতে গিয়ে পানি জমে থাকা গর্তে পড়ে পা ভিজে গেল। ঠান্ডায় পা জমে গেলেও পরিস্থিতির উত্তেজনায় টের পাচ্ছিলাম না। ক্রিস্তেরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কী হতে যাচ্ছে, বোঝার চেষ্টা করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম তাঁরা গাড়ির সঙ্গে আটকানো ট্রেটাতে করে জঙ্গল থেকে কিছু একটা নিয়ে আসতে যাচ্ছে। কিছু দূর এগিয়েই একটা জটলা দেখে নিচে তাকিয়ে আসল ঘটনা টের পেলাম।

হরিণগোত্রীয় এই প্রাণীর নাম মুজ

মাটিতে পড়ে আছে বিশাল একটা মুজ। মৃত। মুজকে সুইডিশরা সাধারণত অ্যালি বলে থাকে। হরিণগোত্রীয় এই প্রাণী সমগোত্রীয় অন্যান্য প্রাণীর চাইতে দীর্ঘ ও শক্তিশালী। আগেই জানতাম ক্রিস্তের লাইসেন্সধারী শিকারি। তাঁর মতো লাইসেন্সধারী শিকারিদের প্রতিবছর নির্দিষ্টসংখ্যক মুজ শিকারের অনুমতি দেওয়া হয়। জানতে পারলাম, কিছু সময় আগে তাঁর গুলিতেই মারা পড়েছে এই মুজ। এখন ট্রেটাতে করে নিয়ে যাওয়া হবে। এর মধ্যেই ক্রিস্তেররা তিনজন কোমরের খাপ থেকে ছুরি বের করে মুজের পেট চিড়ে ভুঁড়ি বের করে ফেলে দিল। আস্ত মুজকে টেনে ট্রেতে তোলা হলো। কায়দা মতো বাঁধার পর চাচা আবার সেই বাইক চালিয়ে জঙ্গল থেকে রাস্তায় টেনে নিয়ে এলেন। প্রায় ২৫০ কেজি ওজনের এই প্রাণীকে টেনে নেওয়াটাও সহজ কম্ম না।

রাস্তায় আনার পর মুজসহ ট্রে গাড়ির সঙ্গে চেইনে লাগিয়ে টেনে ট্রেলারে তোলা হলো। অতঃপর বাইক রেখে আমাদের নিয়ে গাড়িতে রওনা হলেন চাচা। দলের অন্য এক সদস্যের বাড়িতে মুজটাকে কাটাকাটি করে মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হবে।

অবাক হয়ে এদের কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম। বাড়িটার সামনে এসে গ্যারেজের মতো বিশাল একটা কক্ষে ট্রেটাকে ঢোকানো হলো। বোঝাই যাচ্ছে মূলত শিকারের পশু কাটার কাজে ব্যবহৃত হয় এই কক্ষ। পাকা কসাইদের মতো অল্প সময়ে চামড়া ছাড়িয়ে ফেললেন তাঁরা। বাকি কাজ তাঁদের কাঁধে রেখে আমাদের নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলেন রোলফ চাচা। আমাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেলেন।

আগে ভাবতাম, এই বরফের দেশে এসব গ্রামে মানুষ করেটা কী! এবার বুঝলাম গৎবাঁধা চাকরি না, এসব থ্রিলিং ব্যাপারস্যাপারই এদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ড।

উত্তরের আকাশে অরোরা বা মেরুজ্যোতির ঝলকানি

উত্তরের আকাশে আলোর নাচন

বাসায় এসে ঘরে ঢোকার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ভাগ্য আমাদের আজ আসলেই সুপ্রসন্ন। উত্তরের আকাশে হালকা সবুজ আলোর নাচন অরোরা বা নর্দান লাইটের আগমনী জানান দিল। নর্থ সুইডেনে থাকি বিধায় অরোরা আমাদের জন্য খুব নতুন কিছু নয়। এই প্রাকৃতিক ঘটনা দেখার জন্য হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নর্থ সুইডেন বা নরওয়ে আসে অনেক মানুষ। যদিও দেখতে পাওয়ার ব্যাপারটা পুরোটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে।

সূর্য থেকে বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্যাসের সঙ্গে সংঘর্ষে তৈরি করে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ডিসপ্লে। তখন আকাশে তৈরি হয় নানা আলোর প্রতিফলন, যার মধ্যে মিশে থাকে সবুজ, গোলাপি, সাদা, লাল ও হলুদ রং। এই আলোর পরিমাণ মূলত আগত কণার সংখ্যা এবং শক্তির ওপর নির্ভর করে।

বাইরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যে মাইনাসে পৌঁছেছে। বারান্দার কাঠের পাটাতনে বরফের পাতলা আস্তর পড়ে গেছে। লম্বা সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা সহজ না। নর্দান লাইটের শো চলতে চলতেই টের পেলাম ক্ষুধা পেয়ে গেছে। অল্প সময়ে পাস্তা রান্না করে খেয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। আকাশ ততক্ষণে কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। আমাদের বেডরুম থেকে লেক বরাবর বিশাল জানালা। কিছুক্ষণ পর আধো ঘুম চোখে জানালায় তাকিয়ে দেখি নর্দান লাইট অবস্থান পরিবর্তন করে লেকের ওপরে এসে নতুন করে প্রাণবন্ত হয়েছে। বিছানায় শুয়ে এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়াটা কল্পনাতেও ছিল না।

জীবন আসলেই এক জাদুর বাক্স। কখন যে সেখান থেকে কী রোমাঞ্চ বেরিয়ে আসবে বলা মুশকিল। চাই শুধু আকাঙ্ক্ষা আর ধৈর্য।