শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন ষষ্ঠদশ পর্ব।
শ্রীলঙ্কার মোরগগুলোও খানিকটা অলস। অনেক দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। এদের অনেক আগেই টুকটুকের বেকারিগুলো জেগে যায়। অ্যালার্ম বাজিয়ে লোকজনকে জাগাতে জাগাতে এসব ভ্রাম্যমাণ বেকারিগুলোর দিন শুরু হয়। আমার ঘুম ভাঙল টুকটুকের অ্যালার্মেই। সকালে বেরোনোর আগেই লজের মালিক আংকেল জানতে চাইলেন, রং–চা পান করব কি না। কোথায় যেন পড়েছি, বিনা পয়সায় চায়ের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে নেই! তাই কেটলিটা টেবিলে রাখতেই আমরা চায়ের কাপে ঠোঁট ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
আজ হাঁটা শুরু করতেই সিমেন্টের ব্লক বসানো রাস্তা। ওই রাস্তাতেই অতিকায় সব ক্যাকটাস গাছ। খানিক এগিয়ে দুই পাশে ফসলি খেতের মধ্য দিয়ে রাস্তা। সবে ট্রাক্টরের ফলা গেঁথেছে খেতের লালচে মাটিতে। খানিকটা দূরে হাম্বানটোটা মাহিন্দা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। এই বন্য হাতির এলাকায় আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম করার কোনো কারণ আমি অন্তত খুঁজে পেলাম না। ময়ূরের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর সুইচোরা ও বুলবুলির দেখাও মিলল। একটা বিলের মধ্য দিয়ে রাস্তা। পেরিয়ে সুন্দর জলাশয়। এখান থেকে দুই পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা। গা ছমছম করা পরিবেশ। হাতির সামনে না পড়লেই হয়! এ দিকে এই প্রাণীর বেশ দৌরাত্ম্য আছে। দুই-এক জায়গায় হাতির মলও দেখলাম। দুরু দুরু বুকে এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণ নজর রেখে পথ চলছি। মিগাহাজান্দুরা রোডে উঠে তবেই স্বস্তি। এদিকের বসতিগুলোতে হাতির ঢুকে পড়া ঠেকাতে ইলেকট্রিক বেড়া দেওয়া আছে।
আরও একটা ছোট রাস্তা ধরে সাড়ে নয়টা নাগাদ সুরিয়াওয়েয়া। জলাশয়ের নামেই জনপদের নাম। ইডিয়াপ্পাম আর রং–চা দিয়ে নাশতা সেরে আবার পথে। এবার এসে পড়লাম আদিগন্ত বিস্তৃত কলাবাগানে। মনে হচ্ছিল ভুল করে বাংলাদেশের কলার রাজধানী নরসিংদী চলে এসেছি! অবশ্য নরসিংদীর অন্য বিখ্যাত ফল লটকন বা বুবি এখানে অনুপস্থিত। এই রাস্তাটা আরসিসি ঢালাই করা। পুরো ভ্রমণেই কোথাও আরসিসি ঢালাই করা রাস্তা পাইনি। কলাবাগান শেষ হওয়ার পর বিশাল একটা বিল। বিলে ময়ূরের বাইরে আছে প্রচুর কালাগলা মানিকজোড়। এই রাস্তা ধরে এগিয়ে বি-৫৬৩ নম্বর সড়ক। এবার সঙ্গী হলো সেচকাজের জন্য বানানো একটি শুকিয়ে যাওয়া খাল। জায়গার নাম বিহারাগালা।
রাস্তার পাশে বিশাল সব গোসাপ। এরা নির্ভয়ে, নিঃশঙ্ক চিত্তে চলাফেরা করে। আমিও অবশ্য এদের ভয় পাই না। জুমন ভাইয়ের আবার হার্পেটোফোবিয়া আছে। সহজ ভাষায় সরীসৃপ ভীতি। মিনি ট্রাকের স্পিকারে ‘মালো, মালো’ শব্দে মুখরিত এই সড়ক। সিংহলা মালো শব্দের অর্থ মাছ। দেদার মাছ বিক্রি হচ্ছে। ওয়ালাউই গঙ্গা নামক নদীর ওপর সেতু পেরিয়ে প্রবেশ করলাম সাবারাগামুয়া প্রভিন্সে। শ্রীলঙ্কার রাজ্যের সংখ্যা সর্বমোট ৯টি। আমাদের এই পদযাত্রায় পা রাখার সৌভাগ্য হলো ছয়টি রাজ্যেই। নতুন প্রভিন্সের সঙ্গে অবধারিতভাবেই নতুন জেলাতেও পা রাখলাম। জেলার নাম শ্রীলঙ্কার রত্নের রাজধানী বলে খ্যাত—রত্নপুরা।
ওয়াহেরাগোয়াল্লিয়া পুরানা রাজমহা বিহার পড়ল পথে। পাঁচ শিষ্য সমেত বুদ্ধ বসে আছেন। মগধ দেশের উরুবিল্বতে বুদ্ধদেবের সেই কঠিন সাধনাই চিত্রিত হয়েছে এখানে। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন গেরুয়া পরিহিত কয়েকজন সন্ন্যাসী। পথের ধারের বাড়িগুলোর বাগানে চন্দ্রপ্রভা, নীলমণিলতা আর জবার আধিক্য। পাডালাঙ্গালা হয়ে এলা বান্ট রোড পেরোতেই আবার সাউদার্ন প্রভিন্সে প্রবেশ করলাম। চলছি আবেয়েসেকেরাগামার পথে। এখানে আবারও সিমেন্টের ব্লকের রাস্তা। আজ সব ধরনের রাস্তার অভিজ্ঞতাই হয়ে যাচ্ছে। কালো পিচ, লাল মাটির রাস্তা, সিমেন্টের ব্লক কিংবা আরসিসি ঢালাইয়ের রাস্তা—সবখানেই আমাদের পা পড়ছে।
আবেয়েসেকেরাগামার এই রাস্তাই মিশেছে এক্সপ্রেসওয়েতে। নিচের আন্ডারপাস দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে পেরোলাম আমরা। এ দিকে প্রচুর নারকেলগাছ। এক জায়গায় পান চাষ হচ্ছে দেখলাম। ১২ কিলোমিটার ধরে একটাও দোকানের দেখা নেই। জুমন ভাইয়ের খানিকটা কষ্টই হয়ে যাচ্ছে। চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ থামতে পারলে আবার চলার রসদ পাওয়া যায়।
আনগুনাকালোপেসসার রাস্তায় এসে দীর্ঘ সাড়ে তেরো কিলোমিটার পরে একটা দোকান পাওয়া গেল। জুমন ভাই নিলেন কোক-বিস্কুট, আমি কোমল পানীয় পান করি না বলে শুধুই বিস্কুট। আজ সকাল থেকেই আবহাওয়া বেশ গুমোট। আকাশ মেঘে ঢাকা হলেও বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে। উপকূলের দিকে এগোচ্ছি বলেই এমন মনে হচ্ছে কি না, কে জানে! শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষদের বেশ স্থাপত্যপ্রীতি আছে। বেশির ভাগ বাড়ির সামনেই সুন্দর কোনো না কোনো স্থাপনা আছে। মাটির কলসি কাঁখে এক নারীর সিমেন্টের মূর্তিই বেশি জনপ্রিয়।
একটা টুকটুকের পেছনে লিখে রাখা আছে কোটি টাকার প্রশ্ন—হোয়াট উই হ্যাভ ডান টু দিস বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড? (সুন্দর এই পৃথিবীর আমরা কী করেছি?)। চলতে চলতে তা–ই ভাবছি। আমরা তথাকথিত আধুনিক কিংবা সভ্য যুগের মানুষেরাই পৃথিবীর রূপ-রস সবচেয়ে বেশি নিংড়ে একে বানিয়েছি আখের ছোবড়ার মতো শীর্ণ ও দীর্ণ। আর বিনিময়ে রেখে যাচ্ছি টনের পর টন আবর্জনার স্তূপ। প্রস্তর যুগ, লৌহ যুগের ধারাবাহিকতায় এই যুগকে আবর্জনার যুগ বললে একেবারেই অত্যুক্তি হবে না। অবশ্য দেশ হিসেবে আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় শ্রীলঙ্কা বেশ এগিয়ে। আমাদের চেয়ে তো ঢের এগিয়ে। এর পেছনে অবশ্য নাগরিকদের প্রভূত অবদান আছে। এই দেশের নাগরিকদের মননে এবং মজ্জায় পরিচ্ছন্নতাবোধের ব্যাপারটা আছে। নইলে আবর্জনার মতো এমন সর্বগ্রাসী সমস্যার সমাধান রাষ্ট্র কখনোই একা করতে পারে না। রাষ্ট্রের কোনো কিছু করার পরিমাণগত সীমা আছে। সেই সীমাটা ডিঙানো যায় নাগরিকরাও রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্ম হলে।
সোয়া চারটা নাগাদ আনগুনাকালোপেসসা। এটা বেশ বড় কলেবরের শহর। শেষ বিকেল নাগাদ এখানেই সারলাম দুপুরের খাবার। এখানে বুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা। লঙ্কান রুপিতে ৩০০ টাকায় ভেজ মিল খেলাম। বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করলে খরচা দাঁড়ায় মোটে ১২০ টাকা। এরামিনিইয়াইয়া নামক জংশন এই শহরের একদম শেষ মাথায়। এখান থেকে টানা হাঁটা। আমাদের পথ এগিয়েছে রান্না রোড ধরে। পথে ছোট ছোট অনেকগুলো জনপদ পেরোচ্ছি। হাথারামান হান্দিয়া পেরোনোর পর দুই-তিনটা চড়াই পথ আগলাল। দিনের আলো ততক্ষণে উবে গেছে। সন্ধ্যার পাতলা আঁধার সমাগত। সামনের মোড়ে রাস্তা গিয়ে মিশেছে এ-২ মহাসড়কে। স্থানীয়রা বলে থিসসা রোড। এই সড়ক ধরে তিন কিলোমিটার পা চালিয়ে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ গেস্ট হাউজে। কবজিতে লেপ্টে থাকা গার্মিন কোম্পানির ঘড়ি জানাচ্ছে আজ পথ চলেছি সাড়ে ছেচল্লিশ কিলোমিটারেরও কিছু বেশি। আমাদের গন্তব্য শ্রীলঙ্কার সর্ব দক্ষিণের বিন্দু পয়েন্ট ডন্ড্রার বাকি আর ৪২ কিলোমিটার।