সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব
জাহাজের অভ্যর্থনা থেকে দলনেতার জরুরি তলব। সব অভিযাত্রীকে লাউঞ্জে উপস্থিত হতে হবে। ঘোষণায় যদিও বলা হলো, উপস্থিতি গোনার জন্যই ডাকা হচ্ছে। তবে দুদিনের অভিজ্ঞতায়ই বুঝতে পারলাম, কঠিন বৈঠক হবে।
জাহাজের একেবারে নিচতলায় আমার কেবিন। তাই ঘোষণা শুনেই তড়িঘড়ি ওপরে ছুটে গেলাম। দলনেতা বলতে শুরু করলেন, ‘আমাকে বলা হয়ে থাকে এক্সপিডিশন লিডার। কিন্তু আমি মনে করি, আমি তোমাদের হাগ মাস্টার। তোমরা যেকোনো সময় আমাকে হাগ (আলিঙ্গন) করতে পারো।’ তার কথায় চারদিকে মুহুর্মুহু করতালি শুরু হলো।
এবার দলনেতা খানিক গম্ভীর হয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে সংরক্ষণ করার জন্য একটি চুক্তি আছে। এটি অ্যান্টার্কটিক ট্রিটি নামে পরিচিত। এখানে সব ধরনের সামরিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। এ চুক্তি হয় ১৯৪৯ সালে। শুরুতে ১২টি দেশ স্বাক্ষর করে। ২০০৪ সালে এর সচিবালয় হয়েছে আর্জেন্টিনায়।
তিনি আরও যোগ করলেন, ‘অ্যান্টার্কটিক ট্রিটির প্রতি আমাদের যত্নশীল হতে হবে। এমন কিছুই করা যাবে না যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এর প্রাণিজগৎ। পেঙ্গুইন থেকে সদা ১৫ ফুট দূরে অবস্থান করতে হবে। তাদের কোনো রকম খানাখাদ্য খাওয়ানোর চেষ্টা করা যাবে না। জাহাজ থেকে অপারেশনে (ছোট নৌকায় বেড়ানো) নামার আগে প্রতিটি জিনিস যেমন ব্যাগপ্যাক, ক্যামেরার ব্যাগ জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।’
মোদ্দা কথা, অ্যান্টার্কটিকা স্পর্শ করতে পারবে শুধু বুট জুতা। ভাবছি পায়ের বুট কী এমন পূতপবিত্র! তবে সেটাকেও যে পূতপবিত্র করে নিতে হয়, পরে অপারেশনে গিয়ে টের পেয়েছিলাম। জাহাজ থেকে নামার সময় একটি আয়তাকার চৌবাচ্চায় প্রায় ২০ লিটার স্যানিটাইজার থাকে। সেখানে জুতা জীবাণুমুক্ত করে তবেই ছোট নৌকায় (জোডিয়াক) উঠতে হয়। পিকনিক পিকনিক একটা আবহ নিয়ে জাহাজে উঠেছিলাম। দলনেতার কথায় পিকনিক তো ‘প্যানিক’ হতে চলল!
এরপর দুদিন পার হলো। সমুদ্রের কালাপানির অত্যাচারে সবার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। একসময় অ্যান্টার্কটিক সার্কেলে প্রবেশ করল জাহাজ। সমুদ্র এখানে শান্ত। শুরু হলো আমাদের অ্যান্টার্কটিকা অপারেশন। দিনে দুটো করে পাঁচ দিনে দশটা অপারেশন।
প্রথম দুটো অপারেশন করতে গিয়ে হাগ মাস্টারের দক্ষতা, সাহস, একাগ্রতা আমাদের মুগ্ধ করল। কী ভাবছেন, কেতাদুরস্ত হয়ে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করেন তিনি? না, তেমনটি নয়। একটা উদাহরণ দিই। অপারেশন থেকে ফিরে আসার সময় অভিযাত্রীদের পায়ে পেঙ্গুইনের মল লেগে থাকে। একটি ব্রাশ নিয়ে তিনি নৌকার পাদদেশে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমরা পাড় থেকে নেমে জোডিয়াকে বসে বাইরের দিকে পা ঝুলিয়ে দিই। অভিযাত্রীর বুট তিনি পরিষ্কার করতে শুরু করেন। কারণ, অভিযাত্রী নিজে নিজের জুতা পরিষ্কার করার অবস্থায় থাকেন না। একজন অভিযাত্রীকে অপারেশনের সময় বেশ কয়েক স্তর কাপড় পরতে হয়। সব শেষে ওপরে পরতে হয় লাইফ জ্যাকেট। লাইফ জ্যাকেট তো বেশ ভারী। অনেক পোশাক পরার কারণে স্বভাবতই শরীরে ওপরের অংশে অনেক ভারী বোধ হয়। এই অবস্থায় শরীর ঝুঁকিয়ে নিজ হাতে জুতার নিচ পরিষ্কার করা খানিকটা দুরূহ।
এই ভালোবাসায় অভিযাত্রীরা এতটাই আবেগতাড়িত যে ঘোষণা করে বসলেন, যেভাবেই হোক এক্সপিডিশন লিডারের সঙ্গে ছবি তোলার একটা পর্ব চাই। তাঁদের এক দফা, এক দাবি! (চলবে)