জীবনে হয়তো মানুষটার সঙ্গে আর দেখাই হবে না

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মধ্যখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব

রেস্টহাউসে ছেড়ে সকালে বেরিয়ে পড়ার আগে ওয়ার্মআপ
ছবি: বাবরের সৌজন্যে

চতুর্থ দিন: কানাকারইয়ানকুলাম থেকে ভাভুনিয়া। দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার।

কাল রাত থেকেই একটা ব্যাপারে খচখচানি কাজ করছিল। তিন দিন ধরে হাঁটলেও একটা নদীর দেখাও পাইনি। জলাশয় বলতে শুকিয়ে যাওয়া লেগুন বা উপহ্রদ। আমাদের দেশ হলে এই কদিনে অন্তত গোটা পাঁচেক নদীর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। এই অঞ্চলে বেশির ভাগ জায়গার নামের শেষে হয় পুরাম, নয় কুলাম। তামিল কুলাম শব্দের অর্থ আবার জলাশয়। অবশ্য পুকুরও তো জলাশয়। দেখা যাক, আজ নদীর দেখা পাওয়া যায় না। সাইফুল ভাইকে বিদায় জানিয়ে গেস্টহাউস ছাড়লাম। তিনি এখান থেকে সোজা কলম্বো চলে যাবেন। আজ সূর্যের তেজটা সকালবেলা তেমন নেই। রাস্তায় নামতেই দুই পাশ উপচে পড়া মালামাল নিয়ে দুটো ভ্যান অতিক্রম করে গেল। মাসের শেষ দিনে এটি বাংলাদেশের যেকোনো জেলার নিয়মিত দৃশ্য।

এ দিকের ডাস্টবিনগুলোতে তিনটি অংশ। প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম আর গ্লাস—তিন ধরনের বর্জ্যের জন্য আলাদা আলাদা খোপ। ঠিকঠাক পৃথক করে ফেলা হয় না বলে বেশির ভাগ আবর্জনা রিসাইকেল করা যায় না। আমাদের দেশের কথাই বলা যাক। কোমল পানীয় কিংবা পানির বোতলে সয়লাব দেশের অলিগলি থেকে নয়নজুলি হয়ে নদী অবধি। কিন্তু যাঁরা পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে, তাঁরা পুনর্ব্যবহার উপযোগী পর্যাপ্ত প্লাস্টিক পান না। অথচ এই শিল্পের ভালো সম্ভাবনা আছে আমাদের দেশে। পুরো দেশটাই যে কাঁচামালের আড়ত! সঠিকভাবে আবর্জনা পৃথক্‌করণ হয় না বলেই এই সমস্যা।

সকাল থেকে দুই-চার ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। অবশ্য ভিজিয়ে দেওয়ার মতো নয়। পথের দুই পাশের দখল আবার তালগাছের কাছে চলে গেছে। একটা বিদ্যালয়ের সামনে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে শিশুদের রাস্তা পার করে দিচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য!

আমিরথাম রেস্টুরেন্টে প্রাতরাশ

আমিরথাম রেস্টুরেন্টে প্রাতরাশ সারলাম। পুলিয়ানকুলামে এসে পেলাম পিরিতি হোটেল। অল্প এগিয়েই সুন্দর একটা মন্দিরের ফটক। হাতি থেকে ময়ূর—সবার প্রতিনিধিত্ব আছে গেটে। রাস্তার ওপর দিয়ে পার হওয়া ডানা মেলা বিশাল এক ধনেশ দেখলাম। এই বিশাল পাখি দেখলেই মন ভরে যায়। ধনেশ দেখা শেষ হতেই মিলল গণেশ মূর্তি। রাস্তার পাশে মাঝেমধ্যে একটা-দুটো বাড়ি। অধিকাংশই একতলা, ছাদে লাল কিংবা ধূসর টালি। লাল মাটি বিছানো পথ ঘরের দ্বার অবধি চলে গেছে। পথের দুই ধারে নয়নতারা কিংবা বনতুলসীর ঝোপ। বাড়ির উঠোনে পাতকুয়া। এই নিয়ে এ অঞ্চলের ছোট ছোট বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গৃহভক্ত কুকুরের বিরতিহীন ঘেউ ঘেউ। অবশ্য নিজস্ব সীমানা ওরা কেউই ডিঙায় না। আমরা ওদের দেখিনি ভান করে ওদিকে না তাকিয়েই হেঁটে যাই। অপাত্রে ঘেউ ঘেউ করে লাভ নেই বুঝে একটু পর অবশ্য ওরা থেমে যায়।

দিন তিনেক বাদে পথের পাশে ফের ম্যাক্সিকান ক্রিপারের লতানো ঝোপের দেখা পাওয়া গেল। রাবণের দেশে এসে এই প্রথম রাবণের নাম পেলাম। রাবণ স্পোর্টস ক্লাবের অবস্থান পুলিয়ানকুলামে। শ্রী মুথথুমারিয়ামান মন্দিরের ফটক বন্ধ। বাইরে থেকে দেখেই মনের আশ মেটাতে হলো। দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যরীতির এসব নিদর্শন নর্দান প্রভিন্স নামের এই রাজ্য ছাড়ালে আর দেখার সুযোগ খুব একটা মিলবে না। এই ধরনের দেবালয়গুলোর অনেক অংশ থাকে। মণ্ডপা, শিখারা কিংবা গর্ভগৃহের চেয়ে আমাকে বেশি টানে ছোট ছোট দেবমূর্তি দ্বারা অঙ্কিত গোপুরাম নামক ফটকগুলো।

পাশের যাত্রীছাউনিতে থেমে জুমন ভাই জুতার ইন-সক খুলে ফেললেন। এতে জুতার ভেতরের আয়তন নাকি বাড়ে। জুতার এক সাইজের সঙ্গে অপর সাইজের পার্থক্য দুই মিলিমিটার। সারা জীবন ফুটওয়ার নিয়ে চাকরি করা জুমন ভাই থাকাতে জুতার অনেক খুঁটিনাটি জানা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপরই আজ রাস্তার ধারে দোকান পাওয়া যাচ্ছে। পথে বেড়েছে লোকজনের সংখ্যাও। পথচলতি এক-দুজন আমাদের উদ্দেশ্য কিংবা বিধেয় কী জিজ্ঞাসা করছে। রাস্তার পাশে কালো শিরীষের ছড়াছড়ি।

পথের ধারে ডাস্টবিন

পরের জংশন ভিলাকুভাইথাকুলাম। মেঘ-সূর্যের লুকোচুরিতে আজ সূর্য পরাজিতের দলে হলেও বাতাসে প্রচুর আর্দ্রতা। ঘর্মাক্ত শরীরে মাঝেমধ্যে দুলিয়ে দেওয়া বাতাস এলে খুব আরাম লাগে। মহাসড়কের পাশেই অনেক গরু আপনমনে চরে বেড়ায়। বেশির ভাগের চামড়ায় মালিকের নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর খোদাই করা। পাক্কুসোরিনচানে রাস্তার পাশে সুন্দর একটা গাছের ডাল কুড়িয়ে পেলাম। এবার কুকুর আমাদের দেখলেই চুপ হয়ে যায়। যেগুলো রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, ওরা দূরে সরে যায়। দুই-একবার তো উল্টো রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশেও চলে গেল!

ওমানথাইয়ে থামলাম ভান্নি আরসুভাই আগাম নামক রেস্টুরেন্টে। মধ্যবয়স্কা তিন নারী এটা চালান। চারপাশ খোলা রান্নাঘরের চতুর্দিকে বসার চেয়ার পাতা। যথেষ্ট সস্তা খাবার। ভান্নি নামটা এদিকে বেশ প্রচলিত। আজকের গন্তব্য ভাভুনিয়া শহরের নামও একসময় ভান্নি ছিল। কালো শিরীষের অপর নামই ভান্নি। বর্ণচোরা গিরগিটি দেখলাম একদম গাছের সঙ্গে মিশে আছে। ভেপ্পানকুলাম পেরিয়ে ঠান্ডিকুলাম। নাম ঠান্ডিকুলাম হলেও জায়গাটাতে অনেক গরম। একমনে হাঁটছি, হঠাৎ রাস্তার ওপাশ থেকে আওয়াজ। দেখি গতকালের আনা গেস্টহাউসের ম্যানেজার। গাড়ি নিয়ে ভাভুনিয়ার দিকে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে থেমে গেছেন। মনে হচ্ছিল কত দিনের চেনা-পরিচিত মুখ। গাড়ি পার্ক করে রাস্তা পেরিয়ে একগাল হাসি নিয়ে শুভকামনা জানিয়ে গেলেন। এসব উষ্ণতাই আসলে এসব অভিযানের বড় পাওয়া। হয়তো এই জীবনে এই মানুষের সঙ্গে আর কখনো দেখাই হবে না। পথের ধারের অগণিত মাইলফলকের সঙ্গে এসবও কি ফেলে যাচ্ছি? নাকি বুকের গভীরে আজীবন বয়ে বেড়াব?

ভাভুনিয়া শহর

ঠান্ডিকুলামে অশ্বত্থতলের মৌনী বুদ্ধ। খানিকটা এগিয়ে অনমার্ট ক্যাফে। শ্রীলঙ্কান আর্মি চালায় এই রেস্টুরেন্ট। ভেজিটেরিয়ান মিলটা খেতে বেশ ভালো। এখানেই দুই শ্রীলঙ্কানের সঙ্গে পরিচয় হলো। বাংলাদেশ নাম শুনেই ভারতের সঙ্গে চলমান টেস্ট ম্যাচের আপডেট দিতে লাগল। ইতিমধ্যে ভারতের চার উইকেট নাকি পড়ে গিয়েছে। এখান থেকে একটু এগিয়ে ক্যান্ডি অভিমুখী মূল হাইওয়ে ছেড়ে ছোট সড়কে ঢুকলাম। দুই রাস্তার মাঝখানে চলে গেছে রেললাইন। সামনেই ঠান্ডিকুলামের রেলস্টেশন। এই বিকালছোঁয়া দুপুরে পুরো রেলস্টেশনে একটা লোকও নেই! আমাদের দেশের ছোট জনপদের কোনো অজপাড়াগাঁয়ের স্টেশনেও এই চিত্রের দেখা পাওয়া ভার। দুই দিন ধরে জুমন ভাই একটা লিপজেল খুঁজছেন। এতগুলো দোকান ঘুরেও সেটা পাওয়া গেল না। ফাটা ঠোঁটের দাওয়াই হিসেবে লিপজেলের বদলে ভ্যাসলিন খোঁজা হলো। তাতেও বিফল আমরা। এই ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত! এত এত দোকানে একটা লিপজেল কিংবা ভ্যাসলিন নেই!

ভাভুনিয়ার দিকে যত এগোচ্ছি, শহরের ব্যস্ততাও আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। রাস্তায় লোকজনের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। গত চার দিনের হাঁটায় ভাভুনিয়াই প্রথম বড় শহর। নর্দান প্রভিন্স নামক রাজ্যটির একদম সীমান্তে শহরটির অবস্থান। বলা হয়ে থাকে এই জেলার উত্তরে তামিল অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর বসবাস আর দক্ষিণে সিংহলি জনগোষ্ঠীর বাস। আর ভাভুনিয়াতে এই দুই জনগোষ্ঠীর লোকদেরই বসবাস। যাত্রাপথে বেশ কয়েকটা হিন্দু মন্দির পড়ল। খানিকটা এগিয়েই ইউনিভার্সিটি অব ভাভুনিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় শুনে ভেবেছিলাম বিশাল ক্যাম্পাস। পরে দেখি সাকল্যে একখানা ভবন! আর অল্প এগিয়ে আরবান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি লঙ্কার সরকারি গেস্টহাউস। গোছানো বাগানসমেত বিশাল কম্পাউন্ডের এই গেস্টহাউসেই আজকের রাত্রিবাস।

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪