হিমালয়কন্যা নেপাল আমার ভালোলাগার দেশ। কাঠমান্ডু ভালোবাসার শহর। আমার প্রথম অনেক কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নেপাল ও কাঠমান্ডু। আর অন্নপূর্ণার সঙ্গে তো আমার প্রতিদিনের বসবাস! কেননা আমার জীবনসঙ্গী (সুদীপ্ত ইসলাম) নেপালের অন্নপূর্ণা পর্বতশৃঙ্গ দেখে মুগ্ধ হয়ে মেয়ের নাম রেখেছে অন্নপূর্ণা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই তাই অন্নপূর্ণার মুখ দেখি। অন্নপূর্ণার ১৬ মাস বয়সে আমাদের প্রথম বিদেশ ভ্রমণও ছিলো নেপাল। এটাই আমার কন্যা অন্নপূর্ণার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাই নেপাল আমার কাছে স্মৃতিময় একটা দেশ।
একটি প্রশিক্ষণ নিতে ২ নভেম্বর ১০ দিনের জন্য নেপাল যাই। পরিবার ছেড়ে এই প্রথম এত দিনের জন্য দেশের বাইরে থাকব, একটু মন খারাপ লাগা তো ছিলোই। তবে খারাপ লাগার রেশটা কাটতে বেশি সময় লাগেনি। নেপালের আকাশ সীমায় বিমান প্রবেশের পর থেকেই মন ভালো হতে শুরু করে। বিমানের জানালা দিয়ে বরফে ঢাকা হিমালয় দেখে মনে হচ্ছিল সাদা বরফের ভূস্বর্গ দেখছি। নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দর বিমান অবতরণের আগ পর্যন্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছি। এ যেন চোখের আরাম।
পাখির চোখে হিমালয়
বিমানের জানালা দিয়ে হিমালয়ের অপূর্ব দৃশ্য নয়ন ভরে দেখেছি। রেখেছি ফ্রেম বন্দি করে। আগে নানানভাবে হিমালয় দেখেছি। প্রত্যেকটা পাহাড় চূড়ার দৃশ্যই হৃদয়ে লেগে থাকার মতো। পাখির চোখে হিমালয়ের দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত। এত সুন্দর হিমালয়ের রূপ, সেটা ওপর থেকে অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারলাম। নভেম্বরের শুরুর দিকে বরফ জমাট বাঁধতে শুরু করে। তাই এ সময়টা কোথায় সাদা বরফে ঢাকা, কোথায় আবার বরফের চাদরে ঢেকে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
হিমালয়ের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা
বিমানের জানালার পাশে সিট থেকে এবং হোটেলের রুম থেকে হিমালয় দেখা, এবারে দুটোই হয়েছে। প্রশিক্ষণে অংশ হিসেবে ফিল্ড ওয়ার্কের কাজে গ্রামের থাকার দুই দিন বাদে কাঠমান্ডুর লালিতপুরের হোটেল ভিভান্তায় আমার রুমটির জানালা দিয়েই দেখা গেল হিমালয়। ভোর, সকাল, সন্ধ্যা কিংবা রাতের হিমালয় পুরোই রুম থেকে উপভোগ করেছি। হিমালয়ের রূপ একেক সময় একেক রকম। লিখে যা প্রকাশ করা যাবে না। আবার ছবিতেও তাস্পষ্ট হয় না। কিন্তু চোখ ভরে, মন ভরে দেখা যায় সাদা বরফের পাহাড়। এই অনুভূতির কোন তুলনা হয় না।
কাজের ফাঁকে শহর দেখা
কাঠমান্ডুর পর্যটন এলাকার নাম থামেল। এটি কাঠমান্ডুর পুরোনো এলাকা। থামেলের প্রতিটি গলিতে হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং কেনাকাটার প্রচুর দোকান। বেশির ভাগ ভ্রমণকারী থামেলেই থাকেন। তবে আমরা থেকেছি থামেল থেকে একটু দূরে, লালিতপুরে।
লালিতপুরের আশপাশে অনেক রেস্তোরাঁ। নানারকম খাবার। আমরা বেশ কিছু নতুন খাবারের স্বাদ নিয়েছি। প্রশিক্ষণ শেষে হলেই হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছি অলিগলি। আমাদের ক্লাস চলত সকাল থেকে সন্ধ্যা ৭টা অবধি। নেপালে খুব দ্রুতই অন্ধকার নেমে আসে আর সমস্ত দোকান, জাদুঘর বন্ধ হয়ে যায়। আমার ঘুরে বেড়ানো মন। তাই সন্ধ্যা নামলেও আমরা ৩ বাংলাদেশী পাটান জাদুঘর ও বসন্তপুর দরবার জাদুঘর গিয়ে ছবি তুলেছি। কী অসাধারন সব নির্মাণ।
পুরোনো কাঠমান্ডু আর থামেলের আশপাশটা পায়ে হেঁটে ঘোরাটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। পর্যটকদের পদচারণে সন্ধ্যায় থামেলের গলিগুলো জমে ওঠে। ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁর গানের আওয়াজে আমরা মুগ্ধ। সকালের নাস্তার জন্য রাস্তার পাশে ছোট ছোট খাবারের দোকানে পাবেন মোমো, কাঠি কাবাব আর চাওমিন। আর দারুন স্বাদের কফি। তবে ঢাকার মত কাঠমান্ডু অনেক রাত অবধি জেগে থাকে না। রাত ৮টার দিক থেকে রাস্তাগুলো খালি হতে শুরু করে।
কাঠমান্ডু মন্দিরের শহর বললে ভুল হবে না। পুরো শহর জুড়ে ছোট বড় অনেক মন্দির। মন্দিরগুলো ঘুরে দেখেছি আমরা। কাঠমান্ডু এমন একটি শহর, যেখানে প্রতি ইঞ্চিতে মিশে রয়েছে ইতিহাস। নেপাল অনেকটা নিঃশব্দ শহর। একই সঙ্গে নিরাপদ। হর্ন না দিয়ে শত শত মোটরবাইক চলছে রাস্তা পারাপারের সময় পথচারীকে গুরুত্ব দিয়ে থেমে যায়। বিষয়টাতে আমাকে মুগ্ধ করে।
নেপালের গ্রাম
আমাদের প্রশিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো নেপালের গ্রামে গিয়ে তাদের জীবনযাপন দেখা। এটি ছিলো আমার কাছে নতুন এক অভিজ্ঞতা। নেপালের গ্রামগুলোর জীবনমান বাংলাদেশ থেকে বেশ আলাদা। আমি গিয়েছিলাম ফাকালপুরে। ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রামটি কৃষি নির্ভর। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফাকালপুরের সবাই জমিতে চলে যায়। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবনযাপন করে। নারী-পুরুষ সবাই মিলে ফসল ফলায়। সেখানে বেশীরভাগ মানুষ থারু সম্প্রদায়ের। তারা নারী প্রধান কৃষিজীবি সম্প্রদায়। সকাল সকাল নারী-পুরুষ সবাই মিলে জমিতে কাজ শুরু করে। গ্রামে সাধারণত সবারই মাটির ঘর। কারো পাকা দুই তলা বাড়ি থাকলেও এক কোনে মাটির ঘর রয়েছে। মাটির ঘরে সাধারনত ফসল সংরক্ষন করে রাখা হয়। গ্রামের ছোট-বড় সব বয়সী নারীরাই পুরুষের পাশাপাশি ফসলের ক্ষেতে কাজ করেন। নিজের উৎপাদিত সবজি নারীরা সাইকেল চালিয়ে হাটে বিক্রি করতে নিয়ে যায় ।
নেপালের আরো একটা বিষয় দারুণ। নারীরা সব ধরনের কাজ করে। তবে সেখানে বৈষম্য নেই। নারী বা পুরুষের কাজ আলাদা করে বোঝা যায় না। সবাই সমান তালে কাজ করে। তবে নারীরাই বেশ পরিশ্রম করে। ঘরে–বাইরে সবটাই সামলায়।