পর্যটকের ভরা মৌসুমে এই বেলুন রাইডের জন্য কখনো কখনো জনপ্রতি ২৫০-৩০০ ইউরোও গুনতে হয়
পর্যটকের ভরা মৌসুমে এই বেলুন রাইডের জন্য কখনো কখনো জনপ্রতি ২৫০-৩০০ ইউরোও গুনতে হয়

কত টাকায় বেলুনে চড়ে সূর্যোদয় দেখলাম

তুর্কি ভদ্রলোকের ইংরেজিটা শোনায় অন্য কোনো ভাষার মতো। মুখ গোমড়া করে তিনি যা বললেন, সেখান থেকে একটি বাক্য আর কয়েকটি শব্দ কমন পড়ল।

‘আই অ্যাম সরি।...বেলুন...ওয়েদার...ক্যানসেল...’ ইত্যাদি।

বলে কী!

তাহলে আমরা যে ঢাকা থেকে এই সুদূর কাপাডোকিয়ায় উড়ে এলাম প্রায় ৩৪ ঘণ্টার লম্বা সফর করে শুধু বেলুনে চড়ব বলে, তার কী হবে!

মাইনাস ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ভোর পাঁচটায় উঠে তৈরি হয়েছি। তা–ও কি যেনতেন প্রস্তুতি? ইনার পরো রে, সোয়েটার পরো রে, তার ওপর জ্যাকেট পরো রে। সঙ্গে হাতমোজা, পা–মোজা, কানটুপি, নাকটুপি…

দুই মাস ধরে বেলুন রাইডের শ খানেক ভিডিও দেখে দেখে কল্পনার বেলুনে বাতাস দিয়েছি।

সব বৃথা?

সূর্য উঠতে না উঠতেই আকাশে ওড়ে শতাধিক বেলুন
ছবি: লেখক

ডিলে ফ্লাইট, ঢিলে যাত্রা

গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। আমাদের ভ্রমণের শুরু থেকেই আবহাওয়ার সঙ্গে ঠিক বনিবনা হচ্ছিল না। ঢাকার বিমানবন্দরে পৌঁছে শুনি, ফ্লাইট ডিলে। টার্কিশ এয়ার লাইনসের ফ্লাইট ৬ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে। কারণ? কুয়াশা।

কথা ছিল ইস্তাম্বুলে নেমে কাপাডোকিয়ার ফ্লাইট ধরব। কিন্তু এক ‘ডিলে’র ধাক্কায় আমাদের পরের ফ্লাইটটাও মিস। একই পিএনআর নম্বর হলে টার্কিশ এয়ারলাইনসই ব্যবস্থা করে দিত। যেহেতু দুটি টিকিট আলাদা কাটা হয়েছে, ওরা দায়িত্ব নিতে চাইল না। অগত্যা নতুন করে টিকিট কাটতেই হলো। গচ্চা গেল আরও ১০০ ডলার, আর প্রায় ১০ ঘণ্টা!

একটা রাত ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে কাটিয়ে পরদিনের ফ্লাইট ধরে কাপাডোকিয়ায় পৌঁছালাম। শরীরভরা ক্লান্তি নিয়েও গোরেমে শহরটাতে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেল। তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি, তবে আকাশে ঠিকই ঝকঝকে রোদ। হোটেলে কোনোরকমে ব্যাগট্যাগ রেখেই আমরা বেরিয়ে পড়ি।

যোগ–বিয়োগ

৬০ ইউরোতে একটা বেলুনযাত্রার বন্দোবস্ত করে বেশ কলার উঁচু করে গোরেমের রাস্তায় হাঁটছিলাম। প্রাথমিক আলাপ সেরে রেখেছিলাম ঢাকা থেকেই। গ্রীষ্মে, পর্যটকের ভরা মৌসুমে এই বেলুন রাইডের জন্য কখনো কখনো জনপ্রতি ২৫০-৩০০ ইউরোও গুনতে হয়। সেখানে ৬০ ইউরোতে পাওয়া বিরাট ব্যাপার। মনে হচ্ছিল, আশপাশের সবাই বুঝি স্যালুট ঠুকে বলছে, ‘জিতছেন ভাই, জিতছেন।’

কিন্তু কয়েক পা হেঁটে ভ্রম ভাঙল। দেখলাম, রাস্তার জায়গায় জায়গায় দোকানে নোটিশ টাঙানো, ‘ফ্লাই উইথ বেলুন, ৫০ ইউরো।’

পাক্কা ১০ ইউরোর লোকসান! মানে কিনা দুজনের প্রায় ২ হাজার ৬০০ টাকা! মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ঢাকা থেকে ডজনখানেক ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেছি, দরদাম করে ৬০ ইউরোতে রফা হয়েছিল। তা–ও তো দেখি ঠকতেই হলো।

ভ্রমণসঙ্গী আদর রহমান অবশ্য এসব দরদামে বেশ পটু। সে মেসেঞ্জারে ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে বচসা চালিয়ে গেল, ‘তোমরা ৬০ ইউরো নিচ্ছ, এখানে তো দেখি অন্যরা ৫০ ইউরোতে দিচ্ছে।’ 

খুব একটা বেগ পেতে হলো না। ট্যুর অপারেটর জানিয়ে দিল, ‘ওকে, বেলুন রাইড শেষে বাকি টাকা তোমরা ফেরত নিয়ে যেয়ো।’

যা বুঝলাম, এখানে বেলুনে চড়ানো প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা ‘সিন্ডিকেট’ আছে। সবার সেবা এক, দামও এক। ১৯৯১ সালে কাপাডোকিয়া শহরে বাণিজ্যিকভাবে বেলুনে চড়া শুরু হয়েছিল। শুরুতে মাত্র একটা প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিত। এখন নাকি কোম্পানির সংখ্যা আড়াই শতাধিক। তবে প্রতিদিন আকাশে ওড়ার অনুমতি পায় সর্বোচ্চ ১৬৫টি বেলুন।

শুনেছি, আগে বেলুনে চড়াটা নাকি এত ব্যয়বহুল ছিল না। কোভিডের সময় বড় লোকসানের পর সব কটি কোম্পানি একজোট হয়ে দাম বাড়িয়েছে। ডলারের দাম, মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক অস্থিরতা, নানা কারণেই ভ্রমণের জন্য তুরস্ক এখন বেশ ব্যয়বহুল দেশ। গোরেমে শহরটা তুলনামূলক আরও বেশি। এক বেলা ভরপেট খেতেও এখানে একজনের অন্তত ৫০০ লিরা (প্রায় ১ হাজার ৭০০ টাকা) লেগে যায়।

অমূল্য বটে

কাপাডোকিয়ায় আমাদের থাকার কথা তিন দিন। প্রথম দিন রোদঝলমলে হলেও পরদিন ভেসে গেল বৃষ্টিতে। তার পরদিন ঘন কুয়াশায়। ভাবছিলাম, বেলুনে চড়াটা আর হবে না। ১০ ইউরো নয়, পুরো ৬০ ইউরোই ফেরত পাব, এই ভেবে মনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।

কেন জানি না, এখানে বেলুনগুলো ওড়ানো হয় শুধু সূর্যোদয়ের সময়। ওই সময়ে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলেই আর কিছু করার নেই, রাইড বাতিল।

তৃতীয় দিনে এসে আমাদের কপাল খুলল। আগের রাতে ট্যুর অপারেটর মেসেজে জানিয়ে দিল, ‘ভোর পাঁচটায় তৈরি থেকো। তোমাদের নিতে গাড়ি যাবে।’

গাড়ি এল। আগের দিন ফ্লাইং জোন পর্যন্ত পৌঁছে, চোখের সামনে বিশাল বিশাল বেলুন দেখেও চড়তে না পারার হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছে। একটা ড্রেস রিহার্সাল যেহেতু হয়ে গেছে, তাই এই দিন তৈরি হতে একটু সুবিধাই হলো।

সূর্যোদয়ের একটু আগে আমরা ফ্লাইং জোনে পৌঁছালাম। আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো নাশতার প্যাকেট। খেতে খেতে দেখলাম, চোখের সামনে বিশাল বিশাল বেলুন ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেছে। একসময় আমরাও চড়ে বসলাম বেলুনের নিচে বাঁধা ঝুড়িতে।

শুরুতেই ক্যাপ্টেন আমাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন। বড় সাইজের ঝুড়িতে মোট ছয়টি খোপ করা। একেক খোপে চারজন। আমাদের খোপে জায়গা পেলেন আর্জেন্টাইন এক দম্পতি। ফুটবল আর মেসি–সংক্রান্ত আলাপ করে তাঁদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন জানালেন, আমাদের ভ্রমণের ব্যাপ্তি এক ঘণ্টা। ল্যান্ডিংয়ের সময় কীভাবে ধরে বসতে হবে, তা-ও শিখিয়ে দিলেন। এরপর শুরু হলো বেলুনে ধোঁয়া দেওয়া।

আমাদের ঠিক মাথার ওপরই বিশাল যন্ত্রটা থেকে আগুন বেরোচ্ছিল দাউ দাউ করে। সেই আগুনে, নাকি অতি রোমাঞ্চে জানি না, মাইনাস তাপমাত্রায়ও হঠাৎ শরীর বেশ উষ্ণ হয়ে উঠল।

বেলুন ধীরে ধীরে মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ল। চারদিকে আরও কয়েক শ বেলুন। কোনোটা কাছে, কোনোটা অনেক দূরে। কী এক অদ্ভুত দৃশ্য! মনে হচ্ছিল, ভুল করে কোনো ক্যালেন্ডারের ছবির ভেতর ঢুকে পড়েছি। 

সস্ত্রীক লেখক

ওপর থেকে নিচের পাথুরে পাহাড়গুলো দেখেছি বিমানে বসেও। কিন্তু বেলুনে চড়ে দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হয় না। সূর্যটা কীভাবে লাল থেকে কমলা, কমলা থেকে হলুদ, হলুদ থেকে সাদা হয়ে ঝলমল করে উঠল, মনে হলো একদম কাছ থেকে দেখলাম। সূর্যের রঙের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল চারপাশও। 

আমাদের পাশের খোপেই এক ভদ্রলোককে চোখে পড়ল। জাপানি বা কোরিয়ান হবেন হয়তো। একাই এসেছেন। আমরা যখন পাগলের মতো ছবি তুলছি, তাঁকে দেখলাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু দেখছেন। ছবি তোলা দূর, পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন না একবারও। তাঁকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরাও মোবাইলগুলো পকেটে ভরে ফেললাম। ভাবলাম, থাক না, কিছুক্ষণ না হয় ফোনের মেমোরিতে নয়, মাথার মেমোরিতেই দৃশ্যগুলো ‘সেভ’ করি। 

সত্যি বলতে, এই সময়টুকুই ছিল বেলুন রাইডের সেরা সময়, যখন আমাদের হাতে মোবাইল ছিল না, একটা ‘পারফেক্ট’ ছবি ধারণ করার তাড়া ছিল না, বাতাস গায়ে মাখছিলাম আর নিচে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এই বিশাল পৃথিবীতে আমি কত ক্ষুদ্র!

ল্যান্ডিংয়ের জুতসই জায়গা পেতে ক্যাপ্টেনের একটু বেশি সময় লাগল। আমাদের জন্য ভালোই হলো। আমরা পেলাম আরও কিছুক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকার সুযোগ। যখন আমাদের বেলুনটা মাটি ছুঁই ছুঁই করছে, দূরে একটা বেলুন চোখে পড়ল, যার গায়ে বড় করে লেখা ‘প্রাইসলেস’।

সত্যিই তো। সারাটা পথ টাকাপয়সার হিসাব করতে করতে এসেছি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আসলে অমূল্যই।

বেলুনের গায়ে বড় করে লেখা ‘প্রাইসলেস’