২০১৩ সাল থেকে ভ্রমণ পরিচালনা করেন পরাগ আহমেদ। অংশী হয়ে সেন্ট মার্টিনে গড়ে তুলেছেন রিসোর্ট। টাঙ্গুয়ার জলে ভাসানোর জন্য প্রাচীন বাংলার মালার নৌকার আদলে গড়ে তুলছিলেন একটা হাউসবোট। পানিতে ভাসানোর সব প্রস্তুতিই যখন প্রায় শেষ, তখনই নৌকাটা আগুনে পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া নৌকাটা নিয়েই আবার স্বপ্ন দেখছেন এই তরুণ পর্যটন উদ্যোক্তা।
প্রায় এক বছর ধরে অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়েই নৌকার কাজ করেছি। সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য কিছু পরিকল্পনাও করে রেখেছি। তার মধ্যে ছিল বিদেশি পর্যটককে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র বানানো। হাউসবোটের ছবি তোলা। প্রিয়জনদের নিয়ে বাদ্যবাজনা বাজিয়ে নৌকা ভাসানো।
সুনামগঞ্জ শহরের সাহেববাড়ি ঘাটে বাঁধা ছিল নৌকাটা। সব কাজই প্রায় শেষ। ঘাটে আসা পর্যটকেরা বড় বড় চোখে তাকান। ছবি তোলেন। কবে চালু হবে জানতে চান কেউ কেউ। চালুর আগেই চার-পাঁচটা বুকিংও পেয়ে যাই।
নৌকায় তখনো চুলা লাগানো বাকি। চুলা আর উদ্বোধনের কাজেই সুনামগঞ্জ থেকে ১৪ জুলাই রাতে ঢাকায় আসি। সকালে একটু ঘুমিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়ি। বিকেলে জানতে পাই ঘাটে বাঁধা একটা হাউসবোটে আগুন লেগেছে। একটু পরই ছবি আর ভিডিওতে দেখি দাউ দাউ করে পুড়ছে একটা নৌকা। নৌকাটা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুরুতে বুঝতে পারিনি পুড়ছে আসলে আমার স্বপ্ন।
বোঝার পর সুনামগঞ্জে ছুটে যাই। অঙ্গার হয়ে যাওয়া বোটটা ঘাটে বাঁধা। তাকানোর সাহস হয় না। যে নৌকায় বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, সেই নৌকায় দিনদুপুরে কী করে আগুন লাগে, বুঝে পাই না। পাগলের মতো কাটে পরের কয়েকটা দিন।
‘রঙের খেয়া’ নামে আমার ছোট একটা নৌকা আছে। প্রায় ছয় বছর আগে বানিয়েছিলাম। টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রচলিত নৌকাগুলোর মতোই। এখন পুরোনো হয়ে গেছে। হাউসবোটের ভিড়ে এ ধরনের নৌকা তেমন একটা চলে না। তাই সিদ্ধান্ত নিই একটা হাউসবোট বানাব, তবে হাওরের প্রচলিত নৌকার মতো না।
মালার, গয়না, পানসি, বজরার মতো ঐতিহ্যবাহী নৌকা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। শেষে সিদ্ধান্ত নিই, মালার নিয়েই কাজ করব। প্রায় ৩ হাজার বছর আগেও এই বাংলায় মালার নৌকা ছিল। পদ্মা-যমুনার মতো বড় বড় নদীতেও চলত। এ ধরনের একটা নৌকা দেশে এখনো আছে, একটি এনজিও সেটি পরিচালনা করে।
গুগল করে দেখলাম, পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় এই নৌকার চল ছিল। সেখানে গিয়ে কারিগর খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পাকা মিস্ত্রি পাওয়া গেল না। তবে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে মালার তৈরির উপকরণ আর প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। কী কাঠ দিয়ে বানালে নৌকাটা মজবুত হবে, তা–ও তাঁদের কাছ থেকে জানলাম।
২০২২ সালের শুরুতে সুনামগঞ্জের কারিগর দিয়েই শুরু করলাম কাজ। জারুল, শাল, গজারি, লোহাকাঠ জোগাড় করলাম। নিজে গিয়ে গ্রাম থেকে গাছের গুঁড়ি কিনে আনতাম। তারপর স-মিলে মাপমতো কেটে নিতাম। টানা কাজ করে গত জুলাইয়েই হাউসবোটটা প্রস্তুত হয়ে যায়। বাংলার আরেক ঐতিহ্যবাহী নৌকার নামে এর নাম দিই ‘ঝঙ্গ’।
আগুনে হাউসবোটের ৬০ শতাংশই পুড়ে গেছে। গলুইসহ যে অংশটুকু টিকে আছে, তারও বাজারমূল্য ২০-২২ লাখ টাকা, সেটুকু নিয়েই আবার কাজ শুরু করেছি। আমার সঙ্গে দুজন বিনিয়োগকারী ছিলেন। তাঁদের মনের অবস্থা বুঝি। নতুন করে আর তাদের কাছে টাকা চাইনি, এদিক-সেদিক থেকে জোগাড় করে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। জানি না কতটুকু পারব। তবে মালারের আদলে কিছুতেই কোনো পরিবর্তন করব না।
তিলে তিলে গড়া স্বপ্ন শেষ হতে দেব না।
ঝঙ্গ ভাসবেই।