ধরাবাঁধা কোনো চাকরি করেন না জাফর তুহিন। গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। শুধু সপ্তাহের দু-তিনটা দিন এখানে-সেখানে ‘অতিথি’ নিয়ে ঘুরে বেড়ান। এতেই মাসে আয় লাখ টাকা! কীভাবে? জানতে নরসিংদী গিয়েছিলেন সজীব মিয়া
ছেলেপুলেদের কলকাকলিতে সাতসকালেই ঘুম ভেঙে যায়। ঝুলবারান্দায় গিয়ে দেখি, খেলতে বসে হট্টগোল বাঁধিয়েছে ছেলেপুলেরা। তাদের চেঁচামেচি কমলে কড়ইডালে ঘুঘুর ডাক স্পষ্ট হয়। দোতলার বারান্দাটা দক্ষিণমুখী। নিচে ছোট্ট আঙিনা, এক কোণে রান্নাঘর। পাশেই পুকুর। সামনে নারকেলগাছ, মেহগনিগাছ বাতাসে নেচে ওঠে। তাদের ছায়ায় মরিচ, পেঁপেসহ নানা আনাজ তরকারি বেড়ে উঠছে। বাড়ির চৌহদ্দির পর যত দূর দৃষ্টি যায় অবারিত সবুজ মাঠ। কচি ধানগাছে হঠাৎ বাতাস ঢেউ তুলে যায়। শহুরে চোখে এসবই মনে হয় স্বর্গ।
নিউজিল্যান্ডের গেভিন ও সারা স্টfইনার দম্পতির কথা মনে পড়ে যায়। দুই সন্তান নিয়ে গত জুনে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছিলেন তাঁরা। ঢাকায় দুই দিন কাটিয়ে চলে আসেন এই একদুয়ারিয়া গ্রামে। আমার মতোই হন জাফর তুহিনের অতিথি। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাঁরাও নিশ্চয় মুগ্ধ হয়েছেন।
স্টাইনার পরিবার নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার একদুয়ারিয়ায় ছিলেন তিন দিন। এই সময় ঠেলা জাল দিয়ে ডোবায় মাছ ধরেছেন। অনভ্যস্ত হাতে কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছেন। আবার ফসলকাটা ফাঁকা মাঠে বিকেলে ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে বসেছেন পাড়ার চা–দোকানে। তাঁরা গ্রামীণ জীবন শুধু উপভোগই করেননি, উচ্ছ্বাস নিয়ে ব্লগে লিখেছেনও। ‘অ্যাওয়ে উইথ দ্য স্টাইনারস’ ওয়েবসাইটে সারা যে ব্লগ লেখেন, দেশের ভ্রমণবিষয়ক গ্রুপগুলোতে তা শেয়ার হয়েছে। ফেসবুকে তাঁদের দিনযাপনের ছবিগুলোও ভাইরাল হয়েছে।
বিদেশি সারার ব্লগ পড়েই দেশের মানুষ জাফর তুহিনের সঙ্গে আমার পরিচয়। আজ সকালে তাই কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁদের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল, বেলা রুটির ট্রে হাতে বারান্দার নিচে দাঁড়ানো তাঁদের শিশুসন্তানের হাসিমুখের ছবিটাও। যে ছবিতে নিজের ছেলেবেলাকেই যেন খুঁজে পেয়েছিলাম।
এটাই জাফর তুহিনের হোমস্টে। হোমস্টের মূলমন্ত্র—অর্থের বিনিময়ে নিজের বাড়িতে অতিথিসেবা। ধারণাটি অনেক পুরোনো হলেও আমাদের দেশে একেবারেই নতুন। এ ধারণাই জনপ্রিয় করতে কাজ করছেন জাফর তুহিন। এ বছরই নিজেদের দোতলা বাড়ির একটা অংশে পর্যটকদের থাকার উপযোগী করেছেন। যাঁরা বাংলার চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নিতে চান, তাঁদের জন্যই তুহিনের এই প্রয়াস।
১৯ সেপ্টেম্বর। দুজন পর্যটকের গাইড হন জাফর তুহিন। ঢাকার অলিগলি ঘুরে দেখেন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার এই দুই পর্যটক। তাঁদের বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যায় একদুয়ারিয়ার পথ ধরেন তুহিন। আমিও তাঁর সঙ্গী হই। এখানে-সেখানে থেমে একদুয়ারিয়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১২টা।
হাত–মুখ ধুয়ে আবারও জাফর তুহিনের সঙ্গে আড্ডা দিই। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মারা গেছেন। ছোট ভাই পরিবার নিয়ে মনোহরদী শহরে থাকে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মাকে নিয়ে তুহিনও একসময় ঢাকায় থাকতেন। ২০২০ সালের শুরুতে একদুয়ারিয়ায় চলে আসেন। জাফর তুহিন বলছিলেন, ‘ঢাকায় একবার শিকড় গজিয়ে গেলে আর গ্রামে ফেরা হয় না। অনেক দিনের চেষ্টায় আমি পেরেছি। জীবনটাকে এখন উপভোগ করতে চাই।’
একদুয়ারিয়া থেকে ঢাকায় যেতে লাগে ঘণ্টা তিনেক। ব্যক্তিগত বাহনে আরও কম সময়ে পৌঁছা যায়। প্রতি সপ্তাহেই বিদেশি পর্যটক পান তুহিন। বাড়ি থেকে গিয়ে তাঁদের নিয়ে ঘোরেন। শুধু একদুয়ারিয়ায় থাকার জন্যও অনেকে আসেন। সবাই প্রায় বিদেশি। হোমস্টেতে জনপ্রতি এক রাত ৭০ ডলার বা ৭ হাজার টাকা নেন। এ মাসেই এক ইংরেজ দম্পতি তিন দিন থেকে গেছেন। আরও কিছু বুকিং আছে। ফাঁকা বাড়িটায় অতিথি এলে তাঁর মা নাকি বেশি খুশি হন। গ্রামের মানুষেরাও সাদরে গ্রহণ করেন।
প্রাথমিক আলাপেই জেনেছি, জাফর তুহিনের ‘তাঁবু ট্যুর’ নামের একটি ভ্রমণপ্রতিষ্ঠান আছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। তাঁবু ট্যুরের প্যাকেজগুলো মূলত বিদেশি পর্যটকদের কথা ভেবে সাজানো হয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইট (www.taabutour.com) ছাড়াও বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ভ্রমণবিষয়ক ওয়েবসাইট ট্রিপ অ্যাডভাইজার, অস্থায়ী আবাস সন্ধানের জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান এয়ারবিএনবিতে আছে তাঁবুর প্রোফাইল। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকেও অনেক পর্যটক পান জাফর তুহিন। এর মধ্যে ট্রিপ অ্যাডভাইজারের ‘আউটডোর অ্যাকটিভিটিজ ইন ঢাকা সিটি’ শ্রেণিতে তুহিনের তাঁবু শীর্ষে অবস্থান করছে। যেখানে তাঁবুর মতো ৮৬টি প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে থাকে। ঢাকা ও আশপাশে ঘুরে দেখানো ছাড়াও তাঁর প্রতিষ্ঠানে কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল, সুন্দরবনে ভ্রমণের প্যাকেজ আছে। এগুলো ৫০ থেকে ৫০০ মার্কিন ডলারে শুরু হয়। সুযোগ-সুবিধা বাড়লে প্যাকেজের মূল্যও বাড়ে।
২০০৫ সাল। নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় এলেন জাফর তুহিন। গণিত বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে। থাকেন উত্তরার আজমপুরে। প্রথম বর্ষ থেকেই মনে মনে জেদ, বাবার কাছ থেকে আর টাকা নেবেন না। টিউশনিও জোগাড় করে ফেললেন। আজমপুর থেকে কমলাপুর গিয়ে ছাত্র পড়ান।
এভাবে কিছু টাকা জমলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। কখনো শ্রীমঙ্গলে যান, কোনো মাসে বান্দরবানের গহিন পাহাড়ে। কখনো একা, কখনো দলেবলে। তাঁর ভ্রমণের বাতিকটা আরও বেড়ে গেল ‘নিশিদল’ গঠনের পর। এটা তুহিনের পরিচিত কয়েকজন ভ্রমণপিপাসুর দল। যাঁরা ভিন্নভাবে জীবনকে দেখতে চান, তাঁরাই সদস্য। আয়োজন করে রাতে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। রাতের মানুষের জীবন দেখেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটান।
এভাবেই যখন দিন যাচ্ছিল, তখনই খোঁজ পেলেন, পিৎজা হাটে ওয়েটার বা পরিচারক নিচ্ছে। আবেদন করলে আন্তর্জাতিক চেইন রেস্তোরাঁয় কাজের সুযোগটা পান। বেতন সামান্য। তবে বকশিশ বেতনের কয়েক গুণ বেশি। হাতে টাকা এলে মেসের জীবন ছেড়ে বনশ্রী এলাকায় একাই বাসা নেন।
একদিনের কথা, পিৎজা হাটে পল লেইনওয়ান্ড নামের এক মার্কিন নাগরিক খেতে এসেছেন। পেটপূজা শেষে মুঠোফোনে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখছিলেন তিনি। ভদ্রলোক যে কিছু একটা খুঁজছেন, বুঝতে পারেন জাফর তুহিন। আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চান তাঁর কোনো সহায়তা প্রয়োজন কি না। বিদেশি মানুষটা সুন্দরবন ভ্রমণের ব্যাপারে তথ্য জানতে চান তুহিনের কাছে। তিনি তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। তুহিনের ভ্রমণের আগ্রহ দেখে কাউচসার্ফিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন লেইনওয়ান্ড। বলেন, ‘বিদেশে ঘুরতে গেলে এই সাইট ব্যবহার কোরো। এটাতে কোনো খরচ নেই এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেশাও যায়।’
কাউচসার্ফিংয়ে নিবন্ধনের পর কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে অতিথি হিসেবে পান তুহিন। বনশ্রীর বাসায় তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। তাঁদের কেউ কেউ ঢাকায় ঘুরতে চাইলে সহায়তা করেন তুহিন। এভাবে নিজের রুমটাকে এয়ারবিএনবির তালিকাভুক্ত করেন। দিন দিন অনেক পর্যটক আসতে থাকেন, বাড়তে থাকে পরিচিতি। যাঁরা ঘুরে যান, তাঁদের মাধ্যমেই আরও অনেক মানুষকে পেয়ে যান তুহিন। নিজের ওয়েবসাইট ‘তাঁবু’ও তত দিনে চালু করেন। সেখান থেকেও পান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটক।
শুরুতে মাসে দু-একজন পর্যটক পেতেন। দিন দিন বেড়েছে জাফরের বিদেশি অতিথি। বেড়েছে আয়। এখন একদুয়ারিয়াই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বিদেশি পর্যটকদেরও এই গ্রামের মায়ায় জড়িয়ে রাখতে চান জাফর তুহিন।