দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন দশম পর্ব

কুভারভিলে দ্বীপে অভিযাত্রীরা

জোডিয়াক থেকে একটা পাহাড়ের তলে আমরা নেমে পড়ি। পাশ থেকে গাইড জানান, এটি পাহাড় নয়, একটি দ্বীপ। নাম কুভারভিল। তুষারাচ্ছন্ন, জনমানবহীন এই দ্বীপের বাসিন্দা শত শত জেনটু পেঙ্গুইন। দ্বীপটি পেঙ্গুইনদের অন্যতম বৃহৎ কলোনি। আমাদের দেখে তেমন একটা গা করছে না। নিজেদের রাজত্বে তারা নিঃসংকোচ—দৌড়াচ্ছে, ঝপাৎ করে পানিতে লাফিয়ে পড়ছে।

অভিযান শুরুর আগে এই দ্বীপে তিনজন গাইডকে পাঠানো হয়। অপারেশন করা যাবে কি না, তা খতিয়ে দেখেন তাঁরা। পাহাড়ের বরফ পিচ্ছিল হলে হাঁটার জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ে, বরফ ঝুরঝুরে থাকলে নিরাপদ। এসব অবস্থার ওপর ভিত্তি করে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় গাইড।

তিন গাইড আমাদের গতিবিধি ঠিক করে রেখেছেন। ছোট ছোট লাল পতাকা দিয়ে যে সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেটা অতিক্রম করা যাবে না। অভিযাত্রীদের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস, কিন্তু সে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চিৎকার-চেঁচামেচি, হুল্লোড় করা যাচ্ছে না। কারণ একটাই, আমাদের কোনো আচরণে যেন দ্বীপবাসী পেঙ্গুইনদের জীবনযাপনে ব্যাঘাত না ঘটে।

জনমানবহীন দ্বীপের বাসিন্দা শত শত জেনটু পেঙ্গুইন

দ্বীপের চারপাশে হিমশৈল। আমরা হেঁটে হেঁটে দেখছি পেঙ্গুইনের রাজ্য। পেঙ্গুইনরা হাঁটাহাঁটিতে কিছুটা অপটু। তবে সাঁতরায় ভালো। এ এক অদ্ভুত পাখি, মানুষের মতো হাঁটে, পাখির মতো ওড়ে, আবার সাঁতারও কাটে। পানিতে ডুবছে-উঠছে, কিন্তু পালক ভিজছে না। পালক যেন ওয়াটারপ্রুফ। শুনেছি প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের বেশি সাঁতার কাটতে পারে পেঙ্গুইন। বেশির ভাগ পেঙ্গুইন মাছ, স্কুইডসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী খায়। সাঁতার কাটার সময় খাবার পুরোটা গিলে ফেলে। পেঙ্গুইনের জিব কাঁটাযুক্ত এবং পিচ্ছিল, শিকার আঁকড়ে ধরার জন্য শক্তিশালী চোয়াল রয়েছে। পা থেকে গলা অবধি শুধু পেট।

অনেক সময় বরফের ওপর দিয়ে হাঁটছে বুকে ভর দিয়ে, দুই ডানাকে হাতের মতো করে পাখা বানিয়ে। বুক-পেট ধবধবে সাদা। বাকি শরীর কালো বা নীলচে। সবাই কোট-টাই পরা ভদ্রলোক!

একসময় অভিযাত্রীরা কুকুর সঙ্গে নিয়ে অ্যান্টার্কটিকায় আসত। সেসব কুকুর পেঙ্গুইনদের জন্য হুমকি ছিল। এরপর অনেক দিন মানুষ দেখে ভয় পেত। ধীরে ধীরে বিশ্ব নেতৃত্ব প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে। কুকুর কিংবা অন্য কোনো প্রাণী বহন নিষিদ্ধ করেছে। এখন মানুষ দেখে ভয়ও কেটে গেছে।

কুভারভিলে দ্বীপে লেখক

আমার ছবি তোলা প্রায় অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। বেশ কয় বছর ধরে ভ্রমণের সময় লাগেজে দেশের একটি পতাকা নিয়ে আসি, কিন্তু কখনো সেটি নিয়ে ছবি তোলা হয়নি। আজ এই বরফের রাজ্যে লাল-সবুজ ওড়ানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ল। গাইডের অনুমতি নিয়ে আমি পতাকা মেলে ধরি। কে আমার কিছু ছবি তুলে দিতে পারে? একবার ভাবলাম, অভিযানের ফটোগ্রাফারকে বলি, কিন্তু না, তিনি বেশ রাশভারী মানুষ। তাই আগ্রহ হারালাম। কানাডীয় অভিযাত্রী জিমি বলেছিলেন, তিনি ভালো ছবি তোলেন। অবসরপ্রাপ্ত এই ভদ্রলোক কি আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন! নাহলে তিনি শুধু আমার দৃষ্টিতে পড়তে চাইছেন কেন! সে আমার বোঝার অতীত। আমার ভাবভঙ্গি দেখে জিমি এগিয়ে এলেন। ভণিতা না করে ক্যামেরাটা তাঁর হাতেই দিলাম।

ছবি তুলে দেওয়ার পরও ভদ্রলোক আমার পাশ ছাড়ছেন না। ভাব জমানোর চেষ্টা আমার বুঝতে বিলম্ব হয় না। পেঙ্গুইন সম্পর্কে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা শুরু করলেন। তবে সেটি উচ্চ স্বরে নয়। আমি আগ্রহ-অনাগ্রহের মাঝামাঝিতে আছি। মন্দ লাগছে না। কেউ একজন গুরুত্ব দিচ্ছে! জিমির বক্তৃতা শেষ হলো, জিমি আমার ক্যামেরা ফেরত দিলেন।

কুভারভিল দ্বীপটি আবিষ্কার করে বেলজিক অভিযাত্রী দল। সে দলের নেতা ছিলেন বেলজিক নৌ-কর্মকর্তা আদ্রিয়ান দে গারলাচে (১৮৬৬-১৯৩৪)। বেলজিয়ান অ্যান্টার্কটিক এক্সপেডিশন (১৮৯৭-১৮৯৯) শুরুর আগে তিনি একটি জাহাজ কিনেছিলেন। তারপর সেটিকে মেরামত করে অভিযানের উপযুক্ত করে তোলেন। জাহাজের নাম ছিল প্যাট্রিয়া, সংস্কার করার পর নাম দিলেন বেলজিকা। যাত্রাপথে ঝড়ে তাঁর এক সহযাত্রী পানিতে ডুবে মারা যান। একসময় জাহাজের নাবিকদের জন্য পর্যাপ্ত শীতের কাপড়ের অভাব শুরু হয়। বরফের সমুদ্রে বন্দী হয় জাহাজ। সামনে চলার পথ বন্ধ। তার ওপর শুরু হয় মেরু রাতের স্থায়ী অন্ধকার। একসময় খাবার ছিল শুধু পেঙ্গুইন ও সিলের মাংস। গারলাচের এই খাবার ছিল অপছন্দ। অভিযাত্রীদের মধ্যে একসময় স্কার্ভির (ভিটামিন সির অভাবজনিত রোগ) লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন কিছু অভিযাত্রী। অনেকের মধ্যেই জেঁকে বসে মৃত্যুভয়। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হয় যে গারলাচে নিজেও তাঁর উইল লিখে রাখেন।

কয়েক মাস অন্ধকারেই থাকে জাহাজ। বরফ, অন্ধকার, অসুস্থতা—সব কাটিয়ে একসময় তাঁরা প্রবেশ করেন অ্যান্টার্কটিকায়, এই দ্বীপে, যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ফরাসি নৌবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জুল দে কুভারভিলের (১৮৩৪-১৯১২) নামে ভূখণ্ডটির নামকরণ করেন তাঁরা। মজার ব্যাপার হলো, সেই অভিযানে বিখ্যাত নরওয়েজীয় অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমুন্ডসেনও (১৮৭২-১৯২৮) ছিলেন। এখানে আমুন্ডসেনের পদধূলি পড়েছে ভেবে শিউরে উঠি।

আরও পড়ুন