আমি বললাম, ড. ইউনূস আর আমার বাড়ির দূরত্ব আধা কিলোমিটার

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মধ্যখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব

ভাভুনিয়া আরবান কাউন্সিলের ফটক

পঞ্চম দিন: ভাভুনিয়া থেকে রামবেওয়া। দূরত্ব ৩৯ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার।

সরকারি এই রেস্টহাউসটা বেশ সুন্দর। বিশাল কম্পাউন্ডসহ বাগান। কিন্তু যত্নআত্তির অভাব সুস্পষ্ট। তার ওপর কোনো প্রয়োজনে কর্মীদের সাহায্য চাইলে অতিথিদের ডাক কর্মচারীদের কানে সহজে পৌঁছায় না। হাতি আর সিংহের দেশে এমন গণ্ডারের বৈশিষ্ট্য এরা কোত্থেকে পেল, কে জানে! এর চেয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন লজ কিংবা হোম স্টে অনেক গুণে ভালো। সরকারি দপ্তরের চেহারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে এখনো একই।

ভাভুনিয়া শহরের ইনার সার্কুলার রোড ধরে হাঁটা শুরু করতেই রাস্তার ধারে গেরুয়া কাপড় পরিহিত স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি। সকালের শহুরে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে। অফিসগামী বড়দের আর স্কুলগামী শিশুদের ভিড় রাস্তায়। শিশুরা চেপেছে সাইকেলে আর বড়দের বাহন মোটরবাইক। শ্রী বোধিদক্ষিণারামায়াতে অনেক বুদ্ধমূর্তি থাকলেও এখানের মূল আকর্ষণ বিশাল গুঁড়ির বোধিদ্রুমটি। এই গাছের বয়সের কোনো গাছপাথর আছে বলে মনে হয় না। ধ্যানী বুদ্ধ এর তলেই বসে আছেন। পথে পড়ল ভাভুনিয়া এয়ারপোর্ট। বিশাল এক সিংহ বসে আছে সিকিউরিটি ফোর্সের দপ্তরের সিংহদ্বারে। অল্প এগিয়ে ভাভুনিয়া আরবান কাউন্সিলের ফটক। চট্টগ্রামে আমাদের বাড়ির ফটকে যেমন লেখা আছে, ঠিক তেমনি ‘ধন্যবাদ, আবার আসবেন’ লেখা। কিছুটা এগোতেই ইলেকট্রিক তারের ওপর শাখামৃগের দেখা পাওয়া গেল।

যাত্রী ছাউনি

ইরাতপেরিয়াকুলাম রেলস্টেশনের কাছেই ছোট্ট একটা দোকানে থামলাম প্রাতরাশের জন্য। একটা বাড়ির বারান্দায় দুটো চেয়ার পাতা। ভেতরে কিচেন। এই নিয়েই রেস্টুরেন্ট। ইডিয়াপ্পাম নামের তামিল নুডলস খাওয়া হলো ডাল আর নারকেলের চাটনি দিয়ে। সঙ্গে ভড়া কিংবা বড়া। হাঁটা শুরু করতেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। রাস্তার দুই ধারে বিশাল সব বৃক্ষ। নর্দান প্রভিন্স থেকে প্রতি পদক্ষেপে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি নর্দান সেন্ট্রাল প্রভিন্সের দিকে। নর্দান প্রভিন্সের সেই বিরানভূমি ব্যাপারটা নেই। তাতে আমাদের মতো পথিকদের বেশ সুবিধা। ইরাতপেরিয়াকুলামে বেশ কয়েকটি বনেদি হোটেল। রাস্তার ধারে শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র বাহিনীর বিশাল সব স্থাপনা আর অফিস। স্কুটির পেছনে বাইসাইকেল বেঁধে চলা এক লোক রাস্তার ধারে থামাল। ‘আমরা হাঁটছি,’ এইটুকু বলার পরে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘পয়েন্ট পেড্রো টু ডন্ড্রা?’

সুজি নামের এই ভদ্রলোক জানতে চাইলেন সকালে নাশতা করেছি কি না। ভদ্রলোক জানালেন পুরো রাস্তায় কোথাও যদি কোনো সহযোগিতার দরকার হয়, আমরা যেন তাঁকে জানাই। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন নম্বরটি টুকে রাখলাম। কুরুডুপিটিয়ার কাছে তারের ওপর বিশাল এক ইগল। শ্যেনদৃষ্টিতে শিকার খুঁজছে।

এই মহাসড়ক ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন অভিযাত্রীরা

কালুকুন্নামাডুওয়াতে পথের পাশে বেশ কয়েকটা বুদ্ধ নারকেল গাছ। ডানার মতো দেখতে অধিমূলগুলো বেশ নয়নরঞ্জন। দেখতে ছোট নারকেলের মতো, তবে ফল দেখা গেল না। এর নাম বুদ্ধ নারকেল হওয়ার কারণ হলো, এই ফলকে পাত্র বানিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পানি পান করতেন। একটা মজা খালের ওপরের সরু সেতু হলো নর্দান প্রভিন্স আর নর্দান সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মধ্যের সীমানা। সেটি পেরোতেই শ্রীলঙ্কার নয়খানা রাজ্যের দ্বিতীয়টিতে প্রবেশ করলাম। একই সঙ্গে নতুন জেলাতেও। এই জেলার নাম অনুরাধাপুরা। জাফনা, কিলিনোচ্ছি, মুল্লাইতিভু আর ভাভুনিয়ার পরে এ যাত্রায় এটি পঞ্চম জেলা। শ্রীলঙ্কায় সাকল্যে জেলা আছে ২৫টি। এই জেলায় সুদৃশ্য সব যাত্রীছাউনি। নানান গ্রাফিতি করা। পরের জনপদ পুনেওয়া।

মাদাওয়াচ্ছিয়া জামে মসজিদ

প্রবোদাগামা পেরিয়ে রাস্তার ধারে ডাবের পানি পানের বিরতি। আজকে বেশ কয়েক জায়গায় শ্রীলঙ্কার নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দেশনায়েকের পোস্টার দেখলাম। বলিউডের নায়ক মাধবনের সঙ্গে তাঁর চেহারার বিশাল সাদৃশ্য। সামনে এগোতেই লঙ্কান নৌবাহিনীর বিশাল দপ্তর। পথে বন্য হাতি পারাপারের করিডর পড়ল। আজকের রাস্তা বেশ ঢেউখেলানো, চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। এ জন্য গত কদিনের তুলনায় আমাদের দুজনের চলার গতিও কম। তার ওপর আজ গরমে বেশ কাহিল। পথের পাশেই ইসিনবাসসাগালা রুয়ানগিরি রাজামাহা বিহারা। কয়েক শ মিটার উঠতে হয় রাস্তা থেকে। একটাই পাথরের ওপর পুরো বৌদ্ধবিহার। দক্ষিণ ভারতের নামাক্কালে পেয়েছিলাম এমন একটি পাথরের ওপর তৈরি স্থাপনা। নামাক্কালেরটি অবশ্য দুর্গ। এই বিহার থেকে আশপাশের বনাঞ্চলের দৃশ্য অপূর্ব। দিগন্তজোড়া সবুজ গাছপালা। দূরে আবছা পাহাড়ের আউটলাইন। ঘন বনের কারণে ওপর থেকে সামনে-পেছনের রাস্তাই দেখা যায় না। অথচ হাঁটার সময় একবারও মনে হয়নি আমরা কোনো বনের মধ্য দিয়ে হাঁটছি।

রাস্তার ধারের বাজারে একজন মাছ বিক্রেতা

মাদাওয়াচ্ছিয়ার কাছে এক বাড়ির সামনে অলকানন্দা ফুল পেলাম। মাদাওয়াচ্ছিয়া বেশ বড় শহর। পথে সাধু জোসেফের গির্জা। পাশেই জুমা মসজিদে খাওয়ার পানির কল দেখে পানি নিতে থামলাম। আমাদের ঘিরে ছোটখাটো ভিড় জমে গেল। বাড়ি বাংলাদেশ শুনে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ড. ইউনূস অর ইউসুফ?’

আমি এ–সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূর করে জানালাম, ড. ইউনূস আর আমার বাড়ির দূরত্ব আধা কিলোমিটার!

দুপুরে খেলাম বুফে ভেজ লাঞ্চ। প্রতিটা পদ অসম্ভব স্বাদের। একই সঙ্গে সাধ্যের মধ্যেও। খাবার দেখে আর খেয়ে মনের আর পেটের খিদে দুই মিটল। আক্কে (সিংহলি ভাষায় দিদি) খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। আবার পথে নেমে রাস্তার পাশে ফসলি জমি দেখলাম অনেক দিন বাদে। মাইনের উৎপাত এই অঞ্চলে নেই। চষা খেতে মাঝেমধ্যেই দু-চারটা সোনালু আর তালগাছ। সাংগিলিকানাডারাওয়ার পর থেকে রাস্তা বেশ প্রশস্ত। হেলেদুলে হাঁটার জন্যও বেশ অনেকটুকু রাস্তা পাওয়া যাচ্ছে।

শিশুদের সঙ্গে সেলফি

ওয়াহামালগোল্লেওয়া পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই বাতাসে চারপাশ থেকে পাতার ওড়াউড়ি। জলভারাতুর মেঘ চোখ রাঙাচ্ছে আকাশে। যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ার পাঁয়তারা। ইক্কিরিগোল্লেওয়াতে এক লোক থামিয়ে চা খাওয়ালেন। এর মধ্যেই আমাদের ঘিরে শিশুদের ছোটখাটো ভিড়। শিশুদের অনুরোধে সেলফি তোলা হলো বেশ কিছু। আজকে পুরো দিনে ইলেকট্রিক তারে প্রাণ হারানো প্রচুর বাদুড় দেখেছি। সিনোপেকের পেট্রল পাম্পের ঠিক সামনে শুরু হলো বৃষ্টি। সে কী উথাল-পাথাল ঝড়। পেট্রল পাম্পের মাঝবরাবর বসেও বৃষ্টির ছাঁট থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বৃষ্টি আর হাওয়ার তোড়ও দিক পরিবর্তন করছে ক্ষণে ক্ষণে। ঘণ্টা দেড়েক বসে বসে গুলতানি মারা ছাড়া অন্য কিছু করার থাকল না। বৃষ্টির ধারা মিহি হয়ে আসতেই পঞ্চো চাপিয়ে আবার পথে। ততক্ষণে চরাচর অন্ধকার। রামবেওয়াতে আমাদের পছন্দ করে রাখা লজটি ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। টানা হেঁটে আবিষ্কার করলাম, গুগলে ম্যাপে দেওয়া লোকেশনে কোনো লজই নেই! ৫০০ মিটার দূরে একটা হোটেলে গিয়েও বিফল মনোরথে ফিরতে হলো। এই এলাকার অন্য একটা হোটেলেও ঠাঁই হলো না। সব কক্ষ বুকড।

দুপুরের খাবার

শেষ ভরসা দিল ‘রু ভিলেজ ইন’। লজটি মূল রাস্তা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার। রাস্তায় এক ফোঁটা আলো নেই। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে বলে মোবাইলের টর্চও বের করা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে আকাশ ফাড়া বজ্র-বিদ্যুৎ যা একটু আলো দেখাচ্ছে। লাল মাটির পথ ধরে চলছি। মনে হচ্ছে পুরো দিন ট্রেক করে বান্দরবানের কোনো পাড়ার দিকে এগোচ্ছি আশ্রয়ের জন্য। দুই-তিনবার রাস্তার ছোট গর্তে পড়ে জুতা-মোজা ভিজে চুপচুপে। টানা পা চালিয়ে অবশেষে লজে। লজ না বলে হোমস্টে বলাই ভালো। ব্যাংক অব সিলনের সাবেক এক ম্যানেজার এটা চালান। বাড়ির সামনে চওড়া বারান্দা। বৃষ্টি দেখার জন্য একেবারে মোক্ষম জায়গা। অবশ্য শেষ বিকেলে বৃষ্টির খপ্পরে পড়ে আর বৃষ্টি দেখার মতো রোমান্টিসিজম অবশিষ্ট নেই।

১ অক্টোবর ২০২৪