মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন চতুর্দশ পর্ব

লকরয় পোতাশ্রয়
ছবি: সংগৃহীত

অ্যান্টার্কটিকার গৌডিয়ার দ্বীপের পোতাশ্রয়টির নাম লকরয়। এখানে ‘স্টেশন এ’ নামের যে ব্রিটিশ ঘাঁটি আছে, তার তিন-চারটি কক্ষ নিয়ে জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। সেটা একেবারে সাদাসিধে। সংগ্রহে অবশ্য বয়সের ছাপ অতি স্পষ্ট। থাকবেই না কেন, ১৯৪৪ সাল থেকেই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী, প্রকৌশলী, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এই ঘাঁটিতে এসে থাকছেন। তাঁরা যা যা রেখে গেছেন, সেগুলো নিয়েই এই সংগ্রহশালা বা জাদুঘর।

কোন কক্ষে আগে প্রবেশ করতে হবে, কোনটিতে পরে—এমন কোনো নির্দেশনা নেই। আমি প্রথম যে কক্ষে প্রবেশ করি তার দরজায় লেখা ‘বাঙ্ক রুম’। এ কক্ষে পাঁচটি বিছানা পাতা। লেপ-তোশক নজরে এল না, তবে ঝাঁ–চকচকে বিছানার চাদর আছে। এমন পরিচ্ছন্ন চাদর দেখে মনে হলো বর্তমানে কর্মরত চার নারী কর্মকর্তা এই কক্ষেই ঘুমান। কয়েকটি লকারও চোখে পড়ল। দেয়ালজুড়ে লিপিবদ্ধ তথ্য পড়ে বুঝতে পারলাম, অ্যান্টার্কটিকায় স্থাপিত ২০টির বেশি ব্রিটিশ ঘাঁটির মধ্যে এটিই প্রথম। তবে লকরয় ১৯০৩ সালে আবিষ্কার করে ফরাসিরা। ১৯১১ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত জায়গাটা বাণিজ্যিক তিমি শিকারের স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখনো এখানে তিমির হাড় মেলে।

জাদুঘরের একটি কক্ষ

দেয়ালে ঝুলছে খণ্ডিত ব্রিটিশ পতাকা। জানালার পর্দা আমাদের গ্রামীণ চেকের মতো দেখতে। খাটের নিচে নানা বাক্সপেটরা। এসব জিনিসের চেহারা দেখলে বোঝা যায় বয়স পঞ্চাশ-ষাটোর্ধ্ব। দেয়াল আর খাট ঘেঁষে বেশ কিছু লকার আর তাক। তাক দখল করে নিয়েছে এখানে আসা অভিযাত্রী, বিজ্ঞানী ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। বেশ মলিন। অভিযাত্রী আর গবেষকদের জ্যাকেটও ঝুলছে দেয়ালে। বেশ কিছু বইয়ের সংগ্রহও আমার নজর এড়ায়নি।

দেয়ালে আঁকা ডরিস ডে, জেন ম্যানসফিল্ড, ডায়ানা ডরস, আভা গার্ডনার, এলিজাবেথ টেলর, সোফিয়া লরেন এবং জেন রাসেলের প্রতিকৃতি বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ল। ছবির রং আর উজ্জ্বলতা বলে দিচ্ছে এই মডেল ও অভিনেত্রীদের আঁকা হয়েছে বহু বছর আগে। জানতে পারি, ক্যাম্পে কর্মরত থাকতে ছবিগুলো এঁকেছেন ইভান ওয়াটসন নামের একজন। পেশায় তিনি ছিলেন মেকানিক। একটা অসম্পন্ন আঁকা দেখে মনে হলো, এই নারীর হাত আঁকার সময় পাননি ইভান কিংবা তাঁর শিল্পীমন হাতবিহীন নারীকেই কল্পনা করেছেন

চিত্রকর ইভানের আঁকা

এ ছাড়া চিত্রকর ইভান নানা নারী চরিত্র আঁকতে গিয়ে আবেদন তৈরিতে খামতি দেননি। রেখেছেন যৌনতার ইঙ্গিত। ধারণা করা হয়, এগুলো ১৯৬০ সালে আঁকা হয়েছিল। ইভান ওয়াটসন জেনারেটর শেডের পেছনে মেরিলিন মনরোর ছবিও এঁকেছেন। সব বেশ নজরকাড়া।

ইভানের আঁকা ছবিগুলো বহু বছর আড়ালেই ছিল। ১৯৯৬ সালে পোর্ট লকরয় পুনরায় চালু হলে এগুলো আবিষ্কৃত হয়। লাস্যময়ী অভিনেত্রী ডরিস ডে নীল রঙের টপস পরেছেন। ঊরু থেকে হাঁটু অবধি তাঁর পা দুখানা অনাবৃত। উন্নত বক্ষ, তা-ও প্রায় অর্ধ অনাবৃত। জেন ম্যানসফিল্ড? জেন ম্যানসফিল্ড ছবিতে একটি স্কার্ট পরেছেন। ওপরের অংশ সাদা, বুক খোলা। স্কার্টের নিচের অংশ নীল। আমার কাছে দেখতে নার্সের মতো মনে হচ্ছে। আরও বেশ কয়েকটি ছবি। সব ছবিই খাটের পাশের দেয়ালে। দেখে তো মনে হয় শুয়ে শুয়ে এঁকেছেন।

নিয়মিত যোগাযোগের জন্য মোর্স কোডের ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ ব্যবহার করা হতো

আমি এক টুকরা সিনেমাপাড়া থেকে বেরিয়ে পাশের কক্ষে প্রবেশ করলাম। এটি ছিল রেডিও রুম। এ কক্ষে বসে একসময় বিবিসিসহ বিভিন্ন বেতার শোনা যেত। এই কক্ষটিতে যা আছে তা দেখে সে সময়ের যোগাযোগব্যবস্থার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। রেডিও আছে, বিজ্ঞান সরঞ্জাম আছে। নিয়মিত যোগাযোগের জন্য মোর্স কোডের ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ ব্যবহার করা হতো। অ্যান্টার্কটিকা থেকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল এটি। একজন ব্যাখ্যা করে বললেন, সে সময় বার্তা পাঠানো বেশ কঠিন ছিল। প্রতি মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠানো যেত আর ২০০ শব্দের ফিরতি বার্তা পাওয়ার সুযোগ ছিল।

এক কক্ষে পেলাম গ্রামোফোন। এখনো সেটি দিব্যি বাজছে। পাশে ডাইনিং টেবিলের মতো টেবিল, সঙ্গে আটটি চেয়ার। এ কক্ষটির নাম দিয়েছে লাউঞ্জ। এটি তাদের বিনোদনকক্ষ ছিল।

রান্নাঘরে অনেক অনেক কৌটা, থরে থরে সাজানো; সব টিনের। ফ্রাই প্যান, গামলা, বাটি, প্লেট, পানির মগ—কী নেই! রান্নাঘরে জিনিসের ঠাসাঠাসিতে মনে হচ্ছে রান্নার সব জিনিসই অভিযাত্রীরা ফেলে রেখে গেছেন, কিচ্ছু আর সঙ্গে নেননি। আমি কোনো কিছুতে হাত দিইনি। হাতের স্পর্শ নিষেধ।

জাহাজের লাউঞ্জে লেখক

আমাদের ফেরার সময় হলো। বেলা গড়িয়েছে। সূর্যও খানিকটা ক্লান্ত। চার কর্মকর্তার বৈকালিক হাঁটার সময় হলো বলে। অ্যান্টার্কটিকার ডাকঘর আর জাদুঘরকে বিদায় জানিয়ে জোডিয়াকে উঠে বসেছি। বরাবরের মতোই আমার মুখোমুখি বসেছেন জিমি। কীভাবে যেন আমার দুই চোখের ফ্রেমে ঢুকে পড়েন তিনি। জাহাজে পৌঁছে বললেন, ‘রাতে ডিনারের পর যদি লাউঞ্জে আসো, তবে তোমায় পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতে পারি। আমি “টাইটানিক” মুভির সেই বিখ্যাত গানের চার লাইন পিয়ানোতে তুলতে পারি।’

আমি বললাম, ‘আসব!’

আরও পড়ুন

১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?

২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা

৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’

৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি

৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি

৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী

৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি

৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়

৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম

১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই

১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল

১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্‌যাপিত হলো জন্মদিন

১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম