গত ২০ মে রাত সাড়ে ৯টা। আকাশে থালার মতো চাঁদ। কাল বুদ্ধপূর্ণিমা। চাঁদের রুপালি আলোয় চকচক করছে বরফ আর তুষার। ধড়াচূড়া (পর্বতারোহণের সরঞ্জাম) আর শিরস্ত্রাণ (হেলমেট) পরে তাঁবু থেকে যাত্রা শুরু করেছি মাত্র। লক্ষ্য লোৎসের চূড়া। পথ মোটেও সহজ নয়। খাড়া গা ধরে আরোহণ করতে হবে। এখানেই শেষ নয়, চূড়ার পথ আগলে আছে ভয়ানক এক কুলোয়া (পর্বতগাত্রের সংকীর্ণ অংশ, যার মধ্য দিয়ে পাথর, বরফ আর তুষার গড়িয়ে পড়ে)। পথটাকে আরও কঠিন করতে জায়গায় জায়গায় বেরিয়ে আছে ব্লু আইস (একধরনের শক্ত বরফ, যেখানে ক্রাম্পন আটকানোই মুশকিল)। মাথায় নানা হিসাব কষতে কষতে এগোচ্ছি। কীভাবে পথের প্রতিকূলতা পেরোনো যায়, সেটিই দখল করে আছে চিন্তার জগৎ। তবে আসন্ন আরোহণ নিয়ে উত্তেজনাও কম নয়। লোৎসের মতো টেকনিক্যাল পর্বতের গা বেয়ে আরোহণের রোমাঞ্চ যে হাতছানি নিয়ে ডাকছে।
পায়ের নিচে বরফের খচরমচরকে সঙ্গী করে ধীরে ধীরে উঠছি। লোৎসের গায়ে আজ শুধু আমার আর বীরের হেডল্যাম্পের আলো। চলতে চলতে পেছন ফিরে মাঝেমধ্যে এভারেস্টকে দেখে নিচ্ছি। পৃথিবীর সুন্দরতম পর্বতের তালিকা করলে অনেক পেছনে পড়ে থাকবে এভারেস্ট। কিন্তু লোৎসের আরোহণ পথ থেকে এভারেস্ট অপরূপ। তাই আমার নজর সামনের লোৎসের বরফ ছেড়ে ক্ষণে ক্ষণে পেছনের আকাশছোঁয়া এভারেস্টেই আটকে থাকছে। অবশ্য নজর সামনে ফেরালেই আমার আর বীর বাহাদুর তামাংয়ের (শেরপা) কেন যেন ঘুম আসছে। আগের রাতে প্রায় ৭ হাজার ৯০০ মিটার উচ্চতায় বাড়তি অক্সিজেনের সহায়তা ছাড়া ঘুমানোর ফল কি না, কে জানে! আমার ব্যাকপ্যাকের থার্মোসে বরফ গলিয়ে বানানো চা আছে। কিন্তু লোৎসের খাড়া গায়ে সেটা গলাধঃকরণ করার মতো জায়গা কই? দুজনেই সেই কখন থেকে হাই তুলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে চূড়ায় বসেই চায়ের পিপাসা মেটাতে হবে।
পুব আকাশ ফরসা হতে হতে কুলোয়ার নিচের অংশে পৌঁছে গেলাম। আরও সাবধান হতে হবে এবার। ওপর থেকে কিছু গড়িয়ে এলে সেটির যাত্রাপথে বাধা না হয়ে নিচে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সাবধানী চোখ দুটি ওপরে রেখে বরফের বুকে আঁচড় কাটতে কাটতে ওঠা। একপর্যায়ে উঠে গেলাম এমন এক উচ্চতায়, যেখান থেকে আর উঁচুতে ওঠা যায় না। এটাই লোৎসের শিখর।
অনেক দিনের সুপ্ত ইচ্ছা, সর্বোচ্চ পর্বতগুলোর চূড়া থেকে দুনিয়া দেখব। দুই দিনের ব্যবধানে সেই ইচ্ছা দুবার পূরণ হলো—একবার এভারেস্টে, একবার লোৎসেতে। পরপর দুটি আট হাজার মিটার পর্বতের চূড়ার হাড় হিম করা পাতলা বাতাসের রাজ্যে সমুদ্রসমতলের এক ছেলের উষ্ণ নিশ্বাস! নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না।