পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উপকূলজুড়ে বিস্তৃত জলরাশি, ঘন জঙ্গল, দারুণ সব খাবার; তবু এক ডিসেম্বরের সকালে গোয়াতে নেমে মনটা খারাপই হয়ে গেল। সৈকতে শুয়ে শুয়ে দিনমান বই পড়া তরুণী, সমুদ্রে উচ্ছল বন্ধুর দল অথবা পানশালায় ধ্যানমগ্ন প্রৌঢ়কে দেখে মনে পড়ে গেল হাজার তিনেক কিলোমিটার দূরের কক্সবাজারের কথা। কেন? লতিফুল হক শোনালেন সেই বৃত্তান্ত।
চিকিৎসা সূত্রে মুম্বাই যাত্রা। কাজ মিটে গেল তিন দিনেই। ছুটির বাড়তি চার দিন নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করে শেষ পর্যন্ত উঠে পড়লাম গোয়াগামী ট্রেনে। ভারতীয় রেলওয়ের ফরেন কোটায় একটা টিকিট মিলেছিল, কামরায় উঠে দেখি দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক আমার সিটে বসে একমনে বই পড়ছেন। জাতে ব্রিটিশ ওই সহযাত্রী জানালেন, তিনি দিন সাতেক বেনারস ঘুরে, ২৪ ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে মুম্বাই এসেছেন। আজ রাতে আর তাঁর ঘুম আসবে না। আমার লোয়ার বার্থ ছেড়ে যদি ওর মিডল বার্থে যাই খুশি হবেন। বললাম, এ আর বেশি কথা কী! কাউকে দুঃখ দেওয়া অনুচিত, মুম্বাইয়ের প্রচণ্ড গরমে ঘুরে ঘুরে আমিও ক্লান্ত; বেডকভার, কম্বল বিছিয়ে গা এলিয়ে দিলাম।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ঘন জঙ্গল, মধ্যে ছবির মতো একটা স্টেশন। ট্রেন মহারাষ্ট্রের শেষ সীমানায়, একটু পরে ঢুকে যাবে গোয়াতে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল আলোকময় দত্তের লেখা পশ্চিমঘাটের বনে-জঙ্গলের কথা। মহারাষ্ট্রের জঙ্গল আর বন্য প্রাণের অপূর্ব বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। লেখকের দেখা সেই বন আর নিশ্চিতভাবেই নেই, তবে যেটুকু আছে জঙ্গলপ্রেমী হিসেবে উদাস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পাহাড়, জঙ্গলের বুক চিরে ট্রেন চলছে, জানালার পাশে বসে চা-কফি খেতে খেতে প্রিয় বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছি; এমন স্বপ্নই তো দেখে এসেছি। এই পরিস্থিতিকে অনায়াসে বর্ণনা করা যায় সিনেমার জনপ্রিয় সেই সংলাপের সঙ্গে, ‘এই তো জীবন, কালীদা।’
মুম্বাই টু গোয়ার পুরো ট্রেনযাত্রাটাই অসাধারণ, পশ্চিমঘাটের বুক চিরে ছুটে চলা এই রেললাইন চালু হয়েছে ১৯৯৮ সালের ২৬ জানুয়ারি। কোঙ্কন রেলপথ নামে পরিচিত এই পথের বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে পাহাড় আর জঙ্গল কেটে। রাস্তায় ঝরনা, জলপ্রপাত, অরণ্য ছাড়াও আছে অনেক টানেল। সবচেয়ে বড়টির দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার! আশপাশ দেখতে দেখতে চলে এলাম দক্ষিণ গোয়ার মারগাও স্টেশনে।
লোকাল বাসের যাত্রী
স্থানীয় ট্যাক্সিচালকদের সুরক্ষা দিতে গোয়াতে উবার, ওলার মতো রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বন্ধ। স্টেশন থেকে দক্ষিণ গোয়ার পালোলেম সৈকত প্রায় ৪০ কিলোমিটার। ট্যাক্সিভাড়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ রুপি। একা এসেছি, যতটা সম্ভব গরিবি হালতে ঘুরতে চাই। উপায় খুঁজতে ট্যাক্সিচালকদের ডাকাডাকি উপেক্ষা করে স্টেশনের বাইরে হাজির হলাম। এক কোণে দেখি ছোট্ট একটা চায়ের দোকান, অবিকল অভিনেতা মাসুম আজিজের মতো দেখতে একজন পাওয়ের জন্য বড়া ভাজছেন। বেঞ্চে ব্যাকপ্যাক রেখে বসতেই চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন। বয়াম খুলে নিলাম দুটি বিস্কুট। দাম মেটাতে মেটাতে মুশকিল আসান হয়ে গেল। দোকানি জানালেন, ১০ মিনিট হাঁটলেই বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে পালোলেমের বাস মিলবে। শুকরিয়া জানিয়ে হাঁটা লাগালাম। খানিক বাদেই উঠে বসলাম লোকাল বাসে। একটু পরেই বাস শহর ছেড়ে পাহাড়ে ঢুকে পড়ল। জঙ্গলের বুক চিরে উঁচু-নিচু রাস্তা প্রিয় শৈল শহর দার্জিলিংকে মনে করিয়ে দিল। মাত্র ৩০ রুপি ভাড়া গুনে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
এর বেশি চেয়েছি কি
বছর পাঁচেক আগেও গোয়া এসেছিলাম। তবে সেবারের গন্তব্য ছিল উত্তর গোয়া। জমজমাট পরিবেশ, নাইট ক্লাবসহ আরও নানা কারণে গোয়াগামী বেশির ভাগ পর্যটকই বেছে নেন উত্তরকে। দক্ষিণ গোয়া সে তুলনায় শান্ত, নিরুত্তাপ। এখানকার ১৪ আনা পর্যটকই বিদেশি। গোয়ার সৈকতগুলোতে নেই কোনো রিসোর্ট, এমনকি উঁচু কোনো ভবনও নেই। স্থানীয় মানুষ নিজেদের এক বা দোতলা বাড়িতে অতিথিদের রাখার বন্দোবস্ত করেন। সৈকতের পাশে হাতে গোনা কয়েকটি শ্যাক আছে কেবল। যে বাড়ির দোতলায় ঘর মিলেছিল, সেখানকার বারান্দায় বসলেই দেখা যায় সামনে নারকেলগাছের সারি, এরপর জঙ্গল, মাঝে কিছু ফাঁকা জায়গায় চাষের জমি। দক্ষিণ গোয়ার প্রায় সব হোমস্টে বা রিসোর্টের চিত্রই এমন।
দুপুরে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে তাজা হওয়ার পর সৈকতের দিকে এগোতে থাকলাম। পালোলেম এক অদ্ভুত সৈকত, খুব ভিড় নেই; পুরোপুরি ফাঁকাও বলা যাবে না। বিস্তৃত সৈকতের দুই পাশেই পাহাড়, এক পাশে পাথুরে সৈকত; ভাটার সময় অনেকটা দূর পর্যন্ত গিয়ে উঁচু পাথরের ওপর বসে থাকা যায়। পায়ের নিচে এসে ধাক্কা দেয় আরব সাগরের জলরাশি, লোনা জলে ভিজে যায় চোখ-মুখ। সৈকতের অন্য পাশটা ব্যাক ওয়াটার আর জলাবন; জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি আর ব্যাক ওয়াটারের মিষ্টি পানি মিলে যায়। ব্যাক ওয়াটারে আধঘণ্টা নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। নৌকায় যেতে যেতে জলাবনে চোখে পড়ে অসংখ্য ইগল আর সি ইগল। নৌকার মাঝি মাংসের টুকরা পানিতে ছুড়ে মারতেই ঝাঁকে ঝাঁকে সি ইগল ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে এক অপূর্ব দৃশ্য! দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল, সৈকতের রাস্তায় সব বাড়ি আর দোকানে আলো জ্বলে উঠল, পানশালায় ভিড় বাড়তে থাকল। বালুতে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মনে হলো, এর বেশি চেয়েছি কি!
উপভোগের মন্ত্র
গোয়া বিখ্যাত তার অপূর্ব সব সমুদ্রসৈকতের জন্য। তবে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন গোয়া মানেই কেবল সমুদ্র নয়, ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্যটির একটি অংশ পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অংশ হওয়ায় এখানে পাহাড় আর জঙ্গলও আছে ভালোমতোই। ডিসেম্বর, জানুয়ারিতে আবহাওয়া সবচেয়ে মনোরম থাকে। এখানেও ‘কিন্তু’ আছে। কাগজে-কলমে মনোরম হলেও দিনে প্রচণ্ড গরম, দাঁড়ালেই রোদে গা যেন ঝলসে যায়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই এই অবস্থা, অন্য সময় কী হাল হয়, বোঝাই যাচ্ছে। তবে এই গরমই গোয়ার ইউএসপি। তীব্র শীত থেকে পালিয়ে বাঁচতে এ জন্যই এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজির হন ইউরোপীয় পর্যটকেরা।
দিন তিনেক দক্ষিণ গোয়ার সৈকতগুলোতে ঘুরে কয়েক কিসিমের মানুষের দেখা পেলাম। কেউ বালুকাময় সৈকতে শুয়ে-বসে দিনমান বই পড়ছেন। কেউ বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলায় ব্যস্ত, কেউ আবার পুরোটা দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন পানিতেই। একাকী কোনো প্রৌঢ় আবার সময় পার করে দিচ্ছেন পানশালায় বসে সমুদ্র দেখতে দেখতেই। যেতে-আসতে তাঁদের দিকে তাকালে মনে হয় মার্কেসের উপন্যাস থেকে উঠে আসে কোনো চরিত্র। একাকী বা পরিবার নিয়ে ছুটি উপভোগের এ এক আদর্শ জায়গা। বিদেশি পর্যটকদের বেশির ভাগই নিজের মতো করে সময়টাকে উপভোগ করছেন, হাতে কদাচিৎ ফোন দেখা যায়। তাঁরা বরং তারিয়ে তারিয়ে সময়টাকে উপভোগেই বেশি মনোযোগী। আগোন্ডা সৈকতে বসে এসব দেখতে দেখতে চোখ গেল এক জেলে নৌকার দিকে। নৌকা পাড়ে তুলবেন, ঠেলার লোক নেই। বিপুল উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেলেন কয়েকজন, দ্রুতই দল আরও ভারী হলো। মাঝি যতই বলেন আর ঠেলার দরকার নেই, ততই নৌকায় ধাক্কা জোরে লাগে। ততক্ষণে কাজটায় সবাই বেশ মজা পেয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত একেবারে পাহাড়ের গোড়ায় বাড়ি না খাওয়া পর্যন্ত কেউ ক্ষান্ত দিলেন না। যখন এই বিরাট কর্মযজ্ঞ শেষ হলো, তখন সবাই হেসে কুটি কুটি।
উত্তর ও দক্ষিণ গোয়াতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক সমুদ্রসৈকত। প্রতিটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কোনোটিতে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত, কোনোটির চারপাশে পাহাড়, কোনো সৈকতে আবার বিভিন্ন ওয়াটার স্পোর্টসের সুব্যবস্থা আছে, কোনোটি আবার পাথুরে সৈকত, জলে নামা বারণ! কোনো সৈকতে আবার পৌঁছাতে হয় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আধা ঘণ্টা ট্র্যাকিং
করে। তারপর যখন সেই বাটারফ্লাই বিচে যাবেন, তখন দেখবেন দুই পাহাড়ের মাঝে অপূর্ব সেই সৈকতে হয়তো আপনি ছাড়া আর কেউই নেই! কোনো সৈকতের পাশে তিন শ বছরের পুরোনো দুর্গ। দুর্গের ঠিক ওপরে পৌঁছে চারপাশ দেখতে দেখতে হয়তো আপনার মনে পড়ে যাবে সাবেক এই পর্তুগিজ উপনিবেশের ইতিহাস।
কক্সবাজারের জন্য আফসোস
বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত আর পাহাড়ের কথা বললে কক্সবাজারের কথাই আপনার মনে পড়বে। আর প্রায় একই বৈশিষ্ট্যের গোয়ার সৈকতে যখন হাজির হবেন, তখন কক্সবাজারের জন্য মন খারাপ না হয়ে আর যায় না। যে পাহাড় কক্সবাজার সৈকতকে অন্য মাত্রা দিয়েছে, সেই পাহাড় কেবল কোনোমতে টিকে আছে। কক্সবাজার আর টেকনাফের ওই অঞ্চল দেশের বন্য হাতির অন্যতম করিডর ছিল। গত দুই দশকে ওই এলাকার জঙ্গল আর বন্য হাতির কী হাল হয়েছে, তা সবাই জানেন। একের পর এক গগনচুম্বী ভবন আর পরিকল্পনাহীনতার কারণে কক্সবাজারের কলাতলীর দুর্নাম। কিন্তু গত কয়েক বছরে তো ইনানী পর্যন্তই ‘মিনি কলাতলী’ হয়ে গেছে। অথচ গোয়াতে সৈকতের পাশে বড় ভবন আপনার চোখেই পড়বে না। বড়দিনের ঠিক আগে সবচেয়ে পিক মৌসুমে গোয়াতে ছিলাম। সমুদ্র থেকে ঠিক পাঁচ মিনিট হাঁটা দূরত্বে যে রুমে ছিলাম, ভাড়া ছিল মাত্র এক হাজার রুপি! ডিসেম্বরের কক্সবাজার কি তা পারবে?
স্কুটি গোয়ার প্রায় জাতীয় বাহন। ৪০০ থেকে ৫০০ রুপিতে সারা দিনের জন্য ভাড়া নিয়ে পর্যটকেরা ঘুরে বেড়ান। মধ্যরাতেও দেখেছি একা এক বিদেশিনী স্কুটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোনো যুগল আবার সমুদ্রের পাড়ে লেট নাইট ডিনারে ব্যস্ত। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই, প্রায় সব বিদেশিনীই টুপিস বিকিনি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন; কেউ তাঁদের দিকে তাকাচ্ছে না। হকার, ভিক্ষুকের উৎপাত নেই, শীত থেকে পালিয়ে আসা ইউরোপীয় পর্যটকেরা গোয়াতে না গিয়ে আর যাবেন কোথায়!
ফেরার সময় এয়ারপোর্টেও একই অবস্থা, ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশি পর্যটক আসছেন, যা দেখে আবারও মন খারাপ হয়। অপূর্ব সমুদ্রসৈকত, পাহাড় আর জঙ্গলের রাজ্যকে বিদায় জানানোর দুঃখে নাকি কক্সবাজারের জন্য আফসোসে, বলা মুশকিল।