মঙ্গোলিয়ার গোর্খি-তেরেলজ জাতীয় উদ্যান ঘুরে রাজধানী উলানবাটারে ফিরছিলাম। হঠাৎ গাড়ির ব্রেক। ইশারায় আমাকে নামতে বললেন গাইড। গাড়ি থেকে দেখি, এক যাযাবর পরিবারের ডেরা।
স্থাপত্যের শিক্ষক হিসেবে বিশেষ কায়দায় বানানো এই ঘর নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। মঙ্গোলিয়ায় আসার পর থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম। তবে এ যাত্রায় দেখতে পাব ভাবিনি। নীল আকাশের বুকে হেলান দিয়ে সবুজ ঘাসে মোড়া পাহাড়। তার মধ্যে ঘর। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করি। যাযাবরদের ঘর স্থানীয়ভাবে ‘গের’ নামে পরিচিত! গের দেখতে বৃত্তাকার তাঁবুর মতো। এক কক্ষের ঘর। কেন্দ্রে থাকে কলাম। আর বৃত্তের পরিধি বরাবর কাঠের বেড়ার মতো অংশ দিয়ে তৈরি হয় দেয়াল। দেয়াল থেকে ছাদ বরাবর কাঠ দিয়ে টানা দেওয়া থাকে। মূল কাঠামো তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ভারী উলের কাপড় দিয়ে সম্পূর্ণ কাঠামো ভেতর ও বাইরে থেকে আবৃত করা হয়। গেরের কাঠামো সহজেই বিচ্ছিন্ন বা একত্র করা যায়। তাই এটি সহজে বহনযোগ্যও। গেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাকৃতিক বাসস্থানও বলা হয়ে থাকে।
যাযাবর দম্পতির অনুমতি নিলেন গাইড। তাঁরাও আমাদের সাদরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। দরজা পেরিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি ডান পাশে অতিথিদের বসার জায়গা। দরজার বাঁ দিকে গেরের কর্ত্রীর ব্যবহারের জায়গা। সেটুকুতে তাঁর শোবার আর রান্নাঘরের জিনিসপত্র। উত্তর দিকটা কর্তার জন্য সংরক্ষিত। দরজা বরাবর অংশটুকু উপাসনার স্থান। সেখানে পূর্বপুরুষ আর পরিবারের ছবিও স্থান পেয়েছে। গেরের মাঝখানে চুলা। এখানে চুলা রাখার কারণ ধোঁয়া যেন ওপরের বৃত্তাকার খোলা ছাদ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। এই একটি খোলা বৃত্তাকার ছাদ, প্রয়োজনে যা বন্ধ করা যায়, গেরের বায়ু চলাচলের কাজ করে।
দুই-আড়াই মাস হয় দুই সন্তান নিয়ে এখানে ঘর বেঁধেছে এই যাযাবর পরিবার। সর্বশেষ উপত্যকার অন্য একটা জায়গায় ছিল। মিনিট দুয়েক বসার পর কর্তা এলেন, হাতে মুঠোফোন। গুগলে তিনি বাংলাদেশ সার্চ করেছিলেন। সেটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে বললেন, এটাই তো তোমার দেশ? হ্যাঁ বলতেই তৃপ্তির হাসি হাসলেন। একটু পরই পনির সহযোগে তৈরি পিঠা হাতে হাজির তাঁর স্ত্রী। তাঁদের আপ্যায়নে মনটা ভরে গেল।
গেরটায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। রাতে সৌরবিদ্যুতে আলো জ্বলে। তাঁদের একটা গাড়িও আছে। আছে ঘোড়া। গাড়ি-ঘোড়া পাশেই রাখা। যত দিন ঘোড়ার খাবার থাকবে, আবহাওয়া অনুকূল থাকবে, তত দিন এই জায়গায় থাকবেন। তারপর তাঁবু গুটিয়ে নতুন কোনো গন্তব্যে চলে যাবেন।
ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি ব্যবহার করেছে পরিবারটা। পাহাড়ের বৈরী আবহাওয়ায় এভাবেই বসবাস করছে দিনের পর দিন। সাদামাটা আয়োজন নিয়ে অদম্য প্রকৃতির সঙ্গে অনবরত লড়াই করে টিকে আছেন এই মানুষেরা। বিদায়বেলায় যাযাবর মানুষগুলোর প্রতি কেন যেন শ্রদ্ধা বেড়ে গেল!