চিলমারী থেকে নৌকায় উঠেছিলেন দুই বন্ধু নাজমুন নাফিস খান ও তানভীর আল ফারাবী। তারপর এঘাট-ওঘাট করতে করতে পৌঁছে গেছেন কক্সবাজার। পথে নানা অভিজ্ঞতাও হয়েছে। লিখেছেন নাজমুন নাফিস খান
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, তখন চোখে রঙিন চশমা। টেকনাফ, তেঁতুলিয়া—সবই মনে হয় ডালভাত, খালি পকেটে কিছু পয়সা থাকলেই হলো। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন একটা লেখা চোখে পড়ল, নদীমাতৃক বাংলাদেশে কীভাবে কুড়িগ্রাম থেকে নদীপথে কক্সবাজার যাওয়া যায়। বেশ সহজ এক পথ—এই ঘাট থেকে সেই ঘাট, যখন-তখন নৌকায় উঠলেই হলো। আমার বাড়ি বরিশাল। নদীপথের প্রতি ভালোবাসা জন্মগত। বন্ধু ফারাবীকে বললাম, ‘ল মামা যাইগা, জীবন বদলে যাবে।’ কিন্তু আজ টাকা নেই তো, কাল প্রেম নেই, পরশু সেমিস্টার ফাইনাল তো তরশু চাকরির প্যারা। তবে যেকোনো সমস্যার একটাই সম্ভাব্য সমাধান, ‘ল মামা নদীতে যাই।’ কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে না।
গত জুনে এসে দুজনেরই মনে হলো, এবার নদীতে যাওয়া উচিত। কারণ, আমি বিলাত চলে যাব আর ফারাবীর হয়ে যেতে পারে বিয়ে। পরে দেখা যাবে বাকেট লিস্ট সিনেমার মতো এই স্বপ্ন আর কোনো দিন পূরণ হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো ১০ দিনের ছুটি দেবে কে? বন্ধু আমার তার বসকে তেলিয়ে ছুটি নিল। আর আমি নিলাম ডেঙ্গুর বাহানা করে! সাঁতারটা কেউই খুব ভালো না পারায় লাইফজ্যাকেট কিনে আর কিছু কাপড় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ১৯ আগস্ট রাতে কল্যাণপুর থেকে বাসে রওনা দিলাম কুড়িগ্রামের পথে।
প্রায় ৪০০ মাইল জলপথ পাড়ি দিয়ে, ১২টি জেলা ঘুরে ৭ দিনে শেষ হয় আমাদের এই নৌচরণ। কুড়িগ্রামের মোঘলবাসা ঘাটের ধরলা নদী দিয়ে শুরু। ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে, রৌমারী, রাজীবপুর, গাইবান্ধার বালাসী ঘাট হয়ে মৃতপ্রায় করতোয়ার তীরে বগুড়া। সেখান থেকে যমুনা পাড়ি দিয়ে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল। পদ্মার কোল ঘেঁষে মানিকগঞ্জ হয়ে যেতে চেয়েছিলাম চাঁদপুর। কিন্তু পদ্মা উত্তাল। বিপদ কাটাতে তাই পাটুরিয়া থেকে ঢাকায় এসে বুড়িগঙ্গা তীরে দাঁড়ালাম। বুড়িগঙ্গা থেকে লঞ্চে ধলেশ্বরী হয়ে মুন্সিগঞ্জ পাড়ি দিয়ে মেঘনার স্রোতে ভেসে পদ্মা–মেঘনার মোহনায় চাঁদপুর। সেখান থেকে ভোলা ছুঁয়ে হাতিয়া দ্বীপে। একচিলতে দরিয়া পাড়ি দিয়ে নোয়াখালী আসা হয়েছিল সন্দ্বীপ যাওয়ার আশায়। সেই আশাভঙ্গের দুঃখ ভুলতে নোয়াখালীতে এক দিন রয়ে গেলাম। পেলাম দুই ভাইয়ের আতিথেয়তা। পরদিন ভোরে আবার হাতিয়া ফিরে সেখান থেকে এমভি তাজউদ্দীন জাহাজে করে চট্টগ্রাম। আর সেখান থেকে মাল ও মানুষবাহী শাম্পানে সমুদ্রের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে লাইফজ্যাকেটের ভরসায় মহেশখালী। সেখান থেকে স্পিডবোটে কক্সবাজার।
এই বাংলায় নদী এখনো বেঁচে আছে। তবে তা নিতান্তই জোরের ওপর। প্রকৃতির অমোঘ শক্তিতে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা এখনো মানুষের কাছে অদম্য। আবার লোকালয়ের ভিড়ে করতোয়া, আত্রাই, বাঙ্গালী, লৌহজং, বুড়িগঙ্গার মতো অনেক নদী হারাচ্ছে তার প্রাণশক্তি। নদীর পাড়ের মানুষের জীবনে কোটি টাকার বাঁধ নিরাপত্তা হয়তো দিয়েছে, কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা কেড়ে নিচ্ছে তাদের গ্রামীণ সরল জীবন।
উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ঘাটে ঘাটে বৈদ্যুতিক ব্যবহার্যের ছড়াছড়ি, পৌঁছে গেছে স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট। আরামদায়ক জীবিকার উৎস হয়ে উঠেছে বৈদ্যুতিক রিকশা। কোনো এক জমানায় ‘বৈদেশি’ দেখলে মাঝি হয়তো খুশি হতো গল্প করা যাবে ভেবে, আর এখন সে তাকে মালদার পার্টি ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। খাবারদাবারেও নিজস্বতা হারাচ্ছে, সব জায়গাতেই ঢাকা হতে চাওয়ার এক অপচেষ্টা। খালি মিষ্টির দোকানগুলোই টিকে আছে নিজস্বতা ধরে। সহজ-সরল উত্তরের মানুষও চায় টাকা ধরতে। কেউবা বিজয় দাসের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবসা করে, কেউবা সবুজ মাঝির মতো অন্ধকে হাইকোর্ট দেখিয়ে। আর মধ্যবয়স্ক মৃধা সাহেবের চিন্তা উৎকোচ ছাড়া কীভাবে তাঁর ছেলে একটা চাকরি পেয়ে টাকা ধরে আনতে পারে।
বাংলার দক্ষিণেও মানুষের জীবন খুব অনিশ্চিত। সরকারি কোনো উদ্যোগ ঢাকঢোল পিটিয়ে খবরে আসে ঠিকই, কিন্তু তা বন্ধ হয়ে গেলে আসে না। যেভাবে গাদাগাদি করে রাজধানীর মানুষ পাবলিক বাসে চড়ে, সেভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাতিয়ার আফজাল মাস্টারকে শতাধিক মানুষের সঙ্গে ট্রলারে করে দরিয়া পাড়ি দিতে হয়। যেই দরিয়ায় বৃষ্টি নামলে নবজাতকের ভরসা শুধুই তার মায়ের ভেজা ওড়না। এত মানুষের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সরকারি সি ট্রাক বন্ধ রেখে দাপিয়ে বেড়ায় ক্ষমতাসীনের স্পিডবোট। শিক্ষার আলো ছড়ালেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। এ জন্যই নদীর বুকে খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজে দেশ–বিদেশের হাজারো শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ যেমন পাচ্ছে, তেমনি সেই নদীর বুকেই এনায়েতপুরের চরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত তরুণ শিক্ষক রাজীব দিনের পর দিন ছুটি নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে ভালো একটা চাকরির পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার। এত বৈচিত্র্যময় মানুষের মধ্যে একটা বিষয়েই খালি মিল পেয়েছি। তা হলো বিস্ময়! কাজ নেই, কর্ম নেই, বিয়ের উপযোগী দুই যুবক জলপথে দেশ ঘুরে বেড়াতে চায়, যেখানে কিনা বাসে আর অটোরিকশায় সব জায়গায় যাওয়া যায়! এর চেয়ে বিস্ময়ের আর কী হতে পারে।
এই কয়টা দিন রোদে পুড়ে হিমু থেকে রূপাই হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ছিল নৌকা পাওয়া না–পাওয়ার হিসাব মেলানোর ঝক্কি। তার সঙ্গে শহুরে যান্ত্রিক দেহে গ্রামীণ ধকল আর চলনসই বাথরুম খোঁজার চ্যালেঞ্জ, যা শুরু হয়েছিল ২০ আগস্ট সকালে কুড়িগ্রাম জিলা স্কুল থেকে। সব চ্যালেঞ্জ পার হয়ে কক্সবাজারের কলাতলী বিচে যখন পা রাখলাম, উদ্ভাসিত সাগরে তখন ভরা জোয়ার, প্রবল শক্তি নিয়ে ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
আমরা হঠাৎ এক অদ্ভুত খেলা শুরু করি। আধডুবো হয়ে নাক পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে রাখি, অপেক্ষা করি ঢেউ আসার। এভাবে দাঁড়ালে ঢেউগুলোকে মনে হয় পর্বতের মতো। আমরা অপেক্ষা করি। ভয় হয় সত্যি। তবু নড়ি না। পাহাড়ের মতো ঢেউয়গুলো গর্জন তুলে এগিয়ে আসতে থাকে। আমরা চোখ খোলা রেখে দম বন্ধ করে ঠায় অপেক্ষা করি। এমন অপেক্ষায় তো এই বদ্বীপের কত অজস্র মানুষ!