লাটাগুড়ির হোটেল ম্যানেজার বলেছিলেন, গরুমারা অভয়ারণ্য তো দেখবেনই, লাভা ও রিশপ থেকে পারলে কাঞ্চনজঙ্ঘাটাও দেখে নেবেন। আরও ভালো লাগবে এখানকার চা–বাগান, কফিবাগান এবং রাবারবাগান।
ডুয়ার্সে গরুমারা অভয়ারণ্য দেখে পরদিন সকালেই তাই টাটার চা–বাগান দেখতে বেরিয়ে পড়ি। ১ হাজার ১০০ একরজুড়ে বিশাল চা–বাগান। পাশেই দেয়ালঘেরা চা উৎপাদনের কারখানা। চা–বাগানে স্থানীয় তরুণ দীপক বর্মণ পুঁইশাকের বিচির মতো কয়েকটি ফল আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন তো চেনেন কি না?’
ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখে হার মানলাম। বললাম, ‘না।’
উনি আরও কিছু ক্লু দিলেন, ‘এই ফল পাকার আগে সবুজ থাকে। পাকলে রং প্রায় খয়েরি বা গোলাপি হয়ে যায়। ভেতরের বিচি শক্ত হয়ে যায়; পাকা পুঁইশাকের বিচির মতো।’
তখনো বুঝে উঠতে পারিনি আসলে এটি কী ফল।
দীপক বর্মণ বললেন, ‘খেয়ে দেখুন না? ফলটি পেকেছে। এখন আসল স্বাদ পাবেন।’
সাহস পাচ্ছিলাম না। দীপক বুঝতে পারেন, অচেনা ফল খেতে দ্বিধা করছি। তাই আর রহস্য করলেন না, একগাল হেসে বললেন, ‘এটা গোলমরিচ!’
আমিও অবাক। রান্নায় এই গোলমরিচ কত খেয়েছি। আর খেয়েছি সর্দি–কাশিতে। শুনেছি নানা ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার হয় এই গোলমরিচ। বাজারে পাওয়া গেলেও কোনো দিন তো কাঁচা বা পাকা ফল অবস্থায় দেখা হয়নি।
সাহস করে ফলটি এবার মুখে দিলাম। ওপরে নরম। এরপরে শক্ত আবরণের ফল। কামড় দিলাম। সুন্দর একটি গন্ধসহ ঝাল ঝাল স্বাদ। এত সত্যিই আমাদের প্রিয় গোলমরিচ। ইংরেজি নাম ব্লাকপিপার। কেউ কেই বলেন কালো মরিচ।
ওই ব্যক্তি বললেন, এই ফলই শুকালে কালো হয়ে যায়। তিনি আরও বললেন, ‘এই যে বিশাল চা–বাগান দেখছেন, এর মধ্যে যেসব বিরাট বিরাট গাছ দাঁড়িয়ে আছে, লক্ষ করুন, সেই গাছে লতার মতো জড়িয়ে আছে এই গোলমরিচগাছ। দেখতে পানগাছের মতো।’ ভেতর ঢুকে দেখলাম সত্যিই চা–বাগানে ছায়া দেওয়া বড় বড় গাছকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে গোলমরিচের লতাগাছ।
কিছুদূর দূরে এগিয়ে গিয়ে আরও দেখলাম কফিগাছ। থোকায় থোকায় ধরে আছে কফি ফল। আর একটু দূরে দেখলাম রাবারবাগান। প্রতিটি গাছের গোড়া কেটে খেজুরের রসের ন্যায় পাত্রে সংগ্রহ করা হচ্ছে রাবার।
আমাদের পরের গন্তব্য হিমালয় পাদদেশের দুটি পর্বতশৃঙ্গ লাভা এবং রিশপ।
৭ হাজার ৭৭ ফুট উঁচুতে অবস্থিত লাভা দার্জিলিংয়ের কালিম্পং শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার। পাহাড়ের রাস্তা বেশ চওড়া। তবে প্রচণ্ড আঁকাবাঁকা। বারবার বাঁক, ভয়ই লাগে। চিরহরিৎ পাইন আর ধূপির জঙ্গলে রেড পান্ডা, ইগল, চিতাবাঘ, কালো ভালুক, হরিণ আরও কত জীবজন্তু! অদূরেই পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ছাঙ্গে ফলস।
ছোট্ট পাহাড়ি শহর লাভাকে ঘিরে রেখেছে বিরাট বিরাট পাইন। লাভায় আরও রয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক মনাস্ট্রি। অপূর্ব সুন্দর এই মনাস্ট্রিতে থাকেন বহু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। এই পর্বতের ডানে রয়েছে বরফঢাকা সান্দাকুফু, পূর্ব পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ-সিকিম-ভুটান সীমান্ত। আমরা বৌদ্ধ মনাস্ট্রি দেখে চললাম পাহাড়ের আরও উঁচুতে রিশপ। লেপচাদের ছোট্ট একটি গ্রাম। এই রিশপেরই সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় রয়েছে সিঙ্গলীলা পর্বত।
আমরা যখন পর্বতশৃঙ্গে উঠলাম, তখন আকাশ ছিল মেঘমুক্ত। দুই চোখ ভরে দেখলাম বরফে ঢাকা শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা।