শ্রীলঙ্কার দুলহাজ এত ভালো বাংলা জানে দেখে বেশ অবাক হলাম

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মধ্যখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন অষ্টম পর্ব।  

রাস্তার পাশে মাটির তৈজসের দোকান

অষ্টম দিন: অনুরাধাপুরা থেকে কেকিরাওয়া। দূরত্ব ৩৫ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার।

আজই প্রথম কোনো শ্রীলঙ্কানকে প্রাতঃভ্রমণে দেখলাম। তিনজনের একটা দল দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছেন। গত কয়েক দিনে শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্যসচেতন লোক কমই চোখে পড়েছে। আমরা সকাল সকাল বেরোলেও কাউকে জগিং কিংবা মর্নিংওয়াকে বেরোতে দেখিনি। লোকের দেহের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা খানিক আঁচ করা যায়। স্থূল কোমর এখানে বেশ বড় সমস্যাই! এমনকি ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলার সঙ্গে জড়িত ক্রীড়াবিদদের মধ্যেও এটা একটা সাধারণ প্রবণতা।

হাঁটা শুরু করে অল্প এগোতেই কাওয়ারাক্কুলামা জংশন। আজও চলছি এ-১৩ মহাসড়ক ধরে। রাস্তায় স্কুলগামী শিশুরা নানা বাহনে চেপেছে। শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ স্কুলের পোশাক সাদা। আমাদের দেশের অনেক বিদ্যালয়ের মতো রঙের জবরজং নেই। রাস্তার ধারে প্রচুর বৌদ্ধবিহার। ভগবান তথাগতের নানা রং আর আকৃতির মূর্তি। কিছুটা এগিয়ে নাচ্ছাদুওয়া। আজ রাস্তার দুই পাশে সবুজের সমারোহ। গাছপালার ক্যানোপি ভেদ করে রোদ গায়ে পড়ছে না। পথের পাশে আজ অনেক খাবারের দোকান। বেশির ভাগ দোকানে শুদ্ধোধনপুত্র সিদ্ধার্থ আর শিবপুত্র গণেশের অধিষ্ঠান পাশাপাশি। আর দোকানের পেছনের জমিতে শিবের অন্য সন্তান কার্তিকের বাহন ময়ূর চড়ে বেড়াচ্ছে। গালকুলামা নামক স্থানটা এ-১৩ আর এ-৯ মহাসড়কের মোহনা। এখান থেকে এ-৯ নাম নিয়ে সড়কটি এগিয়েছে ডাম্বুলার দিকে। প্রচুর মাটির তৈজসের দোকান এ দিকে। হরেক রকম নকশার এসব জিনিস চোখে পড়লেই কিনতে ইচ্ছা করে। রাস্তার ধারে তরমুজ আকৃতির ছোট ছোট কার্ট। ছোট্ট ব্যবসায়ীরা রকমারি জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছেন।

বাবর আলীর সেলফিতে জুমন নিয়াজ ও দুলহাজ (বাঁয়ে)

সকাল থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেলের জুনিয়র দুলহাজের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ক্যান্ডির পাশেই মাতালে শহরে ওদের বাড়ি। সে আমার পাক্কা ১০ ব্যাচ জুনিয়র। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। কাল রোববার ফ্লাইট থাকলেও আমার সঙ্গে দেখা না করে শ্রীলঙ্কা ছাড়বে না। সেটা নিশ্চিত করতে ফ্লাইট পিছিয়েছে। নয়টা নাগাদ সে মাতালে থেকে নিজের গাড়িতে করে চলে আসতেই একটা রেস্টুরেন্টে বসে পড়লাম। এভারেস্ট ও লোৎসে আরোহণের পরে আমার মেডিকেল কলেজে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, সেটা দুলহাজ মিস করে গেছে। তার অন্য শ্রীলঙ্কান বন্ধুরা আমার সঙ্গে ছবি দেখিয়ে বলেছিল, ‘লুক হুম উই মেট টুডে!’ দেখা করার সুযোগটা এবার সে হাতছাড়া করতে চায়নি। ইডিয়াপ্পাম আর চা খেতে খেতে ঘুরে ফিরে আসছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কিংবা চকবাজারের কথা। দুলহাজ এত ভালো বাংলা জানে দেখে বেশ অবাক হলাম। আমার ব্যাচের শ্রীলঙ্কান বন্ধুরাও এত ভালো বাংলা বলতে শেখেনি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে বাংলাদেশে এসে সবচেয়ে ভালো বাংলা বলতে শেখে নেপালি শিক্ষার্থীরা। ভালো বাংলা বলতে পারার পেছনের কারণ হিসেবে জানাল বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ স্যারের কথা। স্যার নাকি প্রথম লেকচার ক্লাসেই তাকে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছিলেন বাংলা শেখার জন্য! স্যারের ভয়ে তটস্থ হয়েও অনেকটুকু বাংলা শিখেছে সে।

শ্রীলঙ্কান ডিশ কট্টু আমার অন্যতম পছন্দের জেনে দুলহাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা ডলফিন কট্টু চেখে দেখেছি কি না।’ নাম শুনে ভড়কে গিয়ে স্বভাবতই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কি ডলফিন দিয়ে রান্না হয়?’

ময়ূর চড়ে বেড়াচ্ছে

উত্তর শুনে অবশ্য আশ্বস্ত হলাম। মূলত রুটি দিয়ে বানানো হয় কট্টু। এগুলোকে ধারালো ছুরি দিয়ে ছোট ছোট টুকরা করার সময় রুটির ক্ষুদ্র অংশগুলো ডলফিনের মতো ওড়াউড়ি করে বলেই এহেন নাম! এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম এরপরে দুলহাজের কী পরিকল্পনা। জানাল, বাংলাদেশে বিয়ে করে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা! বাংলাদেশি এক সহপাঠীই তার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’! আবার ওই সহপাঠীকে তার প্রেম নিবেদনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত কাপ্তাই কায়াক ক্লাবের কায়াক। কায়াক চালিয়ে মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে সহপাঠীকে নিজের ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল। জানতে চাইলাম, সহপাঠী অন্তর থেকে নিজের ভালো লাগার কথা জানিয়েছিল নাকি সাঁতার না জানার ভয়ে হ্যাঁ বলেছিল?

তাকে এক ফাঁকে জানিয়ে রাখলাম কাপ্তাই কায়াক ক্লাবের মালিকানায় আমারও ছোট্ট একটা অংশীদারত্ব ছিল একসময়। লোকে এখানে এসে ডুবে ডুবে কিংবা কায়াকে ভেসে ভেসে জল খেলেও আমার ভাগে ছিটেফোঁটাও পড়েনি!

পিঠার নাম ইম্বুল কিরিবাত

আজকে আমরা অনুরাধাপুরা থেকে রওনা হয়েছি শুনে দুলহাজ বলল, ওখানে তার এক চাচা থাকে। তাদের পরিবারের বাকি সব সদস্যই মাতালে শহরে থাকে। চাচা কী বুঝে এত দূরে থাকে, এটা নিয়ে আফসোস করার পর তাকে জুমন ভাই মনে করিয়ে দিল, ‘সব ঠিক থাকলে তোমার শ্বশুরবাড়ি হবে বাংলাদেশ! কই অনুরাধাপুর আর কই বাংলাদেশ!’

দুই দেশের পর্যটন নিয়ে কথা উঠতেই দুলহাজ বলল পর্যটনের অবকাঠামোর দিক থেকে অনেক অনেক এগিয়ে শ্রীলঙ্কা। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এখানে সমাজের প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে পর্যটনে সংযুক্ত। এদিক থেকে আমরা যোজন যোজন পিছিয়ে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দুলহাজকে বিদায় দিলাম। সে মাতালে শহরে নিজের বাড়িতে ফিরবে।

রাস্তার ধারে ছোট ছোট ছাউনিতে হরেক রকমের ফল বিক্রি হচ্ছে। ফলের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে ফুলও। অবশ্য এসব ফুলের ভাগ্যে প্রিয়ার খোঁপা জুটবে না। মন্দিরের দেবতাকে তুষ্ট করার কাজেই ব্যবহৃত হবে পুষ্পগুলো। ফুল-ফলে চোখ রাখতে রাখতেই থিরাপ্পানে। এগিয়ে থিরাপ্পানে থানা। এদের থানাগুলোও মানুষগুলোর মতো শান্ত আর মৌন। আমাদের দেশে থানা ঘিরে সব সময় মৌমাছির অতি ব্যস্ত চাকের মতো ভিড়। এখানে আশপাশে কিচ্ছুটি নেই। জুমন ভাইয়ের মতে এরা থানাগুলো বন্ধ করে দিলেই পারে! আজকের আবহাওয়া বেশ চমৎকার। ক্ষণেক রোদ, ক্ষণেক ছায়া আর সঙ্গে বাতাস। কলম্বো-জাফনা যাত্রাপথে বাস যে জায়গায় যাত্রাবিরতি দিয়েছিল, সেটাকে আমরা কুমিল্লা নাম দিয়েছিলাম! মূল জায়গার নাম পেরিয়াম কুলাম। আজ মহাসড়কের সেই রেস্টুরেন্টটা চিনতে পেরে চায়ের জন্য থেমে পড়লাম। এখান থেকে একদম হাতছোঁয়া দূরত্বে পাহাড়।

কেকিরাওয়া শহর

কিছুটা এগিয়ে মারাদানকাদাওয়ালাতে ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের সেই মধ্যবয়সী নারীদের দোকান। জুমন ভাই আর আমি বলি খালাদের দোকান। এই দোকানের খাবারের মান যথেষ্ট ভালো আর দামটাও পকেটের রেস্ততে কুলিয়ে যায়। শঙ্খের মতো দেখতে পিঠার নাম ইম্বুল কিরিবাত। ওপরে ভাতের আবরণী আর ভেতরে গুড় মেশানো নারকেলের পুর। দাঁতের ওপর অল্প খাটাখাটনি করেই এর পুরো রসটুকু আস্বাদন করা যায়। ইম্বুল কিরিবাতের সঙ্গে নিলাম প্যাশন ফ্রুটের জুস। আমাদের কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে আনারকলি নামে চড়া দামে বিক্রি হয় এই ফল। এদের জুসটা বেশ ভালো খেতে। কিছুটা এগিয়ে ডাইনোসরের হাতে সাইনবোর্ড দেখলাম! জগতে টিকে থাকলে এমন কাজে ব্যবহৃত হতে হতো বলেই হয়তো ওরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে!

থাওয়ালামহামিল্লেওয়াতে ‘সমাধি’ নামে একটা হলিডে রিসোর্ট পাওয়া গেল। এত তাড়াতাড়ি সমাধিস্থ হওয়ার ইচ্ছা নেই বলে তাড়াতাড়ি পা চালালাম। দুপুরের খাবার সেরে অলুকারান্দা জংশন। অল্প এগিয়ে মালাওয়া ওয়েয়া নামক শুকিয়ে যাওয়া জলাশয় পেলাম। নানা প্রজাতির প্রচুর পাখি কাদা খুঁচিয়ে পোকা খেতে ব্যস্ত জলাশয়ের ধারে। আরও কিছুক্ষণ পা চালাতেই কেকিরাওয়া শহর। অল্প খোঁজাখুঁজি করে থানার অদূরেই ডাউনটাউন নামক হোম স্টে খুঁজে নিলাম। ছোট্ট বাড়ির এক কোণের দুই কামরা পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেন মালিক ভদ্রলোক। মুখমণ্ডলে পথের ছাপ পড়া হাঁটতে বেরোনো দুই যুবকের প্রতি মালিকের আন্তরিকতার অন্ত নেই। (চলবে)

৪ অক্টোবর ২০২৪