আমাদের আতাতুর্কের তুর্কি ভ্রমণের অংশ ছিল কাপাডোকিয়া। আমাদের বলতে আমার স্ত্রী মেহেরুন, আমাদের ছোট মেয়ে সাফাত, সাফাতের বান্ধবী করোল ও আমি। কাপাডোকিয়া তুরস্কের একটি বিশেষ অঞ্চল। অনন্য ভূতাত্ত্বিক আগ্নেয়শিলা, ভূগর্ভস্থ প্রাচীন শহর এবং উপত্যকার বিস্ময়কর দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত কাপাডোকিয়া। হট এয়ার বা গরম বাতাসভর্তি বেলুনের জন্য কাপাডোকিয়ার খ্যাতি আছে। প্রতিদিন সকালে খোলা আকাশকে রাঙিয়ে তোলে এই বেলুন। হাইকিং ও ঘোড়ায় চড়ার উত্তম জায়গা হিসেবেও দুঃসাহসিক ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এলাকাটি অত্যন্ত প্রিয়।
কাপাডোকিয়ায় বেশ কয়েকটি পাহাড় আছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে উপত্যকা। হাইকিংয়ের জন্য পর্যটকদের কাছে প্রিয় রেড ভ্যালি, রোজ ভ্যালি, পিজিয়ন ভ্যালি, ইহলারা ভ্যালি, ডেভরেন্ট ভ্যালি, সোগানলি ভ্যালি ও লাভ ভ্যালি।
রেড ভ্যালি নামটা মনে হয় পাহাড়ের রং থেকে হয়েছে। সারা দিন গোলাপি শিলার ওপর সূর্যের আলো পড়ে রক্তিম দেখায়, যা সূর্যাস্তের সময় সত্যিই অপূর্ব লাগে। সেই লাল রঙের কারণ হলো পাথরের মধ্যে লোহার জারণ। হাজার হাজার বছর ধরে নিকটবর্তী আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে গঠিত হয়েছে এই অনন্য ভূতাত্ত্বিক গঠন। পরে বাতাস ও বৃষ্টির কারণে উত্তপ্ত লাভা শীতল ও শক্ত হওয়ার জন্য ফানেল-আকৃতির ছোট ছোট পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল। এগুলো ‘রূপকথার চিমনি’(ফেইরি চিমনি) নামে পরিচিত। এগুলো কাপাডোকিয়া অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকে জনবসতিপূর্ণ ছিল। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাচীন বসতির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। বাইজেন্টাইন আমলে রেড ভ্যালি এলাকার অনেক গ্রাম পরিত্যক্ত হয়েছিল। তবে উনিশ শতকে এলাকাটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয়। রেড ভ্যালি গোরেমে হিস্টরিক্যাল ন্যাশনাল পার্কের অংশ। একই সঙ্গে ইউনেসকোরও এটি বিশ্ব-ঐতিহ্য। সেখানে আইকনিক ফেইরি চিমনি এবং ঐতিহাসিক গুহার অভ্যন্তরে বাসস্থান রয়েছে।
সকালে হোটেলে নাশতা সেরে আমরা তৈরি হয়ে লবিতে অপেক্ষা করি। আটটার গাড়ি সাড়ে আটটায় আসে। আমরা ছিলাম শেষ যাত্রী। আমাদের ট্যুরের প্রথমেই ছিল কাপাডোকিয়ার সৌন্দর্যের লীলাভূমি রেড ভ্যালি, যা আমাদের হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা সেখানে পৌঁছে যাই।
গাড়ি থেকে নেমে আমরা গাইডকে অনুসরণ করে নিচের দিকের পথ ধরে হাঁটতে থাকি। সে মাঝেমধ্যে থেমে আমাদের বর্ণনা দিচ্ছিল। পথটি বেশির ভাগই ছিল সমতল, তবে ধুলায় ধূসরিত। পথের পাশে বৈচিত্র্যময় শিলা, গুহা ও সুড়ঙ্গ রয়েছে। প্রায় ৪৫ মিনিট হাইকিং করার পর আমরা উপত্যকার ডান দিকে পথের শেষ মাথায় পৌঁছাই। সেই চূড়ায় উঠে চারদিকে তাকালে শুধু চোখই তৃপ্তিই পায়নি, মনও ভরেছে।
হাইকিং করার পথে বেশ কয়েকটি গির্জা, মসজিদ, পাহাড়ের ওপরে একটি ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। সেখানে তাজা বেদানা ও কমলার রস বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া শৌচাগারও রয়েছে। পর্যটকেরা অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন। জানা যায়, বাইজেন্টাইন গ্রিকরা উপত্যকার কৃষি ও গুহার ভেতর গির্জা নির্মাণ করে। তারা কয়েক কিলোমিটার পানির নালা ও বিশাল আকৃতির পুকুর খনন করেছিল। বাসস্থানের জন্য তারা উপত্যকার মেঝেতে টেরেস তৈরি করেছিল।
উপত্যকার নির্দিষ্ট পথে হাইকিং করে ঘুরে আসতে আমাদের প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছে। ওপর থেকে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করে ফিরে আসতে সময় লেগেছিল তিন ঘণ্টার বেশি। গাড়িতে ওঠার পরই আমার মনে হলো, পেটের ভেতর ক্ষুধা নামক বাঘটা একটু নড়েচড়ে উঠল। সবাই ওঠার পর গাইড মাথা গুনে চালককে সবুজসংকেত দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা ছিল। হয়তো মধ্যদুপুর, তাই। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে এক রেস্তোরাঁর পাশে থামে। গাইড বলল, সেখানেই আমাদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়েছে। মেন্যুতে বিশেষ খাবার ছিল স্থানীয় পদ্ধতিতে রান্না করা গরুর মাংস। বড় গাছের নিচে খোলা জায়গায় ঘাসের ওপর টেবিল সাজিয়ে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খানিক দূরে আরেকটি টেবিল সাজাচ্ছিলেন রেস্তোরাঁর লোকজন হয়তো অন্য আরেক দলের জন্য।
টেবিলে বসার আগে অনেকে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। যারা যায়নি, তারা আশপাশে গাছের ছায়ায় ঘোরাঘুরি করে। আমি অল্প কিছুক্ষণ ঘুরে এসে দেখি, একটা বিড়াল আমার চেয়ারের নিচে পায়চারি করছে। গাইড আমাদের সতর্ক করে বলে, বিড়ালকে খাবার দেওয়ার নিয়ম নেই। রেস্তোরাঁর লোকজন নির্ধারিত সময়ে ওদের খাবার পরিবেশন করবেন।
আমরা সবাই নির্ধারিত টেবিলের দুই পাশে বসি। বসার পরই প্রথমে আমাদের দেওয়া হয়েছে ডালের গরম স্যুপ ও টার্কিশ রুটি। তারপর দেওয়া হয় ভাত এবং আমাদের পছন্দমতো দেওয়া হয় মাটির পাত্রে গরুর মাংসের ঝাল তরকারি অথবা কিমা দিয়ে তৈরি মিটবল কারি। আমরা যেহেতু চারজন, তাই দুটি করে তরকারি নিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়েছি। মূল খাবারের সঙ্গে টার্কিশ পদ্ধতিতে রান্না করা ভাত ও রুটি ছিল। মিষ্টান্ন হিসেবে সবশেষে ছিল বিখ্যাত টার্কিশ বাকলাভা। খাবারের পরিমাণ যথেষ্ট ছিল এবং সুস্বাদুও। তবে বোতল পানি ১৫ লিরা করে কিনতে হয়েছে। সত্যি, খোলামেলা পরিবেশে খাবার খুব উপভোগ করেছি। খাবারের ফাঁকে আমাদের সবার সঙ্গে সবার পরিচয় বিনিময় হয়। এক ঘণ্টার মধ্যাহ্নভোজের বিরতি ছিল।
একসময় গাড়িতে ওঠার জন্য আমাদের হালকা তাড়া দেয় গাইড। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সবাই বাসে নিজেদের আসন গ্রহণ করি। একসময় বাস চলতে শুরু করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।