চিলমারীর শাখাহাতি দ্বীপে যেভাবে হলো বছরের প্রথম সূর্য দেখার উৎসব

বছরের প্রথম দিনে অপ্রচলিত জায়গায় অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পের আয়োজন করে থাকে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। আয়োজনটির নাম দিয়েছেন তারা সূর্য উৎসব। এবারের উৎসব হয়েছে চিলমারীর শাখাহাতি দ্বীপে। সেখানেই বছরের প্রথম সূর্য দেখলেন জাহানুর রহমান

বছরের প্রথম দিনের সূর্য দেখতে চিলমারীর শাখাহাতি দ্বীপে গিয়েছিলেন তাঁরা
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা থেকে রওনা হওয়া উৎসবের অতিথিরা ৩০ ডিসেম্বর সকালে কুড়িগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে নামেন। আমি কুড়িগ্রামের মানুষ। তাই স্টেশনেই তাঁদের সবার সঙ্গে পরিচয়। সবার সঙ্গে নাশতা সেরে শহর দেখাতে নিয়ে গেলাম। শহরতলির উত্তরবঙ্গ জাদুঘরও ঘুরে দেখলেন তাঁরা। এরপর চিলমারী বন্দরের পথ ধরলাম। এই বন্দর হয়েই দ্বীপচর শাখাহাতি যাব আমরা।

হাড়কাঁপানো শীত

উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে এমনিতেই শীত একটু বেশি। তবে চর শাখাহাতিতে যে এত শীত পড়বে, তা কেউ কল্পনাও করিনি। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের মাঠে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা। ঠান্ডায় ঠকঠক কাঁপুনির মধ্যেই যে যাঁর মতো তাঁবু খাটালাম। শীতে কাবু হয়ে কেউ কেউ তাঁবু বাদ দিয়ে শ্রেণিকক্ষে আশ্রয় নিলেন। রাতে খাবারের জন্য বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। খাবারের চেয়ে একটু আগুনের আঁচ নিতে আমরা সবাই হুড়মুড় করে বারবিকিউয়ের চুলাকে ঘিরে ধরলাম। কে কাকে ঠেলে আগুনের পাশে যেতে পারে, সে–ও এক অন্যরকম উৎসব।

ছিল টেলিস্কোপে চাঁদ দেখার আয়োজন

টেলিস্কোপে চাঁদ দেখা

বিজ্ঞানকর্মী আহসান উল্লাহ সন্ধ্যার পর পরই টেলিস্কোপ নিয়ে ক্যাম্পের খোলা মাঠে হাজির। উদ্দেশ্য টেলিস্কোপে চাঁদ দেখা। চরের মানুষ জীবনে প্রথমবারের মতো টেলিস্কোপ দেখছে। তাঁদের কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এলেন। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হলো, চাঁদ তো খালি চোখেই দেখা যায়, টেলিস্কোপে চোখ দিয়ে কী দেখবে? প্রশ্ন শুনে জসিম উদ্দিনের সরল জবাব, চাঁদের কলঙ্ক দেখব! চাঁদের কলঙ্ক বলে যে কিছু নেই, তা জসিমকে বুঝিয়ে বলা হলো। তারপর উল্কার আঘাতে চাঁদের গায়ে তৈরি হওয়া গর্তগুলো টেলিস্কোপে খুব পরিষ্কার দেখল জসিম। আহসান উল্লাহ সবাইকে আকাশের বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র সম্পর্কে ধারণা দিলেন। ক্রমেই ঘন হয়ে আসে কুয়াশা, টেলিস্কোপে ঝাপসা হয়ে আসে চাঁদ, গায়ে সারা দিনের ক্লান্তি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি আমরা।

 

বিজ্ঞান উৎসব

৩১ ডিসেম্বর সকাল। দই বিক্রেতার ‘দই নেবেন, দই’ ডাকে ঘুম ভাঙে। পুব আকাশে তখনো ভোরের সূর্য ওঠেনি। আস্তে আস্তে এলাকার ছোট শিশুদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ। সকাল ৯টায় শুরু হয় স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে আয়োজন ‘ছোটদের জন্য বিজ্ঞান’। বিজ্ঞানকর্মী জুয়েল ও শিশুমেলার পরিচালক নাহিদ হাসানের সঞ্চালনায় এতে অংশ নেয় চিলমারীর ১৫০ শিশু। বিজ্ঞান উৎসবের প্রথম অংশে প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা নিজের খুশিমতো রংপেনসিলে ছবি আঁকে। প্রত্যেকেই পুরস্কার জেতে।

ছোটদের বিজ্ঞান উৎসব শেষে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আয়োজকেরা

মুক্তিযুদ্ধের গল্প

বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী সৈয়দ সামিউল ইসলাম উৎসবে অংশ নেওয়া শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমান শিশুদের মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেন। সময় গড়িয়ে যায়। ক্লান্ত অভিযাত্রীদের সঙ্গে ক্লান্ত হয় বছরের শেষ সূর্য, ডুব দেয় দিগন্তের ওপারে। 

নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয় ফানুস উড়িয়ে

ক্যাম্প ফায়ার ও ফানুস ওড়ানো

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বর্ষবরণের প্রস্তুতি। আলোকসজ্জার জন্য রঙিন কাগজ কেটে হারিকেন, সূর্যমুকুট, প্রদীপ জ্বালানোর জন্য পাট কেটে সলতে বানানোর প্রস্তুতি চলতে থাকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। উৎসুক জনতার অনেকেই উৎসবে যোগ দেন। রংপুর থেকে তিন সদস্যের সংগীত দল ক্যাম্পে এসেছে সন্ধ্যায়। সব মিলিয়ে ৩১ ডিসেম্বর রাত চর শাখাহাতি দ্বীপবাসীর জন্য উৎসবের রাত হয়ে ওঠে। ক্যাম্প ফায়ার ও গানের তালে সময় গড়িয়ে রাত ১২টা বাজলে ব্রহ্মপুত্রের পারে ফানুস উড়িয়ে ২০২২ সালকে বিদায় ও ২০২৩ সালকে স্বাগত জানানো হয়।

সূর্যমুকুট মাথায় সূর্য দেখা

চর শাখাহাতির মানুষের রাতের ঘুম তখনো ভাঙেনি। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মশহুরুল আমিনের ডাকাডাকিতে আমরা জেগে উঠি। বছরের প্রথম দিনের সূর্য দেখতে আমরা চরের পূর্ব-উত্তর দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সমবেত হই। কুয়াশার আড়াল থেকে সূর্য তখনো দেখা দেয়নি। উৎসবের কর্মীরা সবাই মাথায় সূর্যমুকুট পরে নদের পারে এসেছিলেন। প্রচণ্ড শীত কিন্তু প্রত্যেকের চোখ নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখার জন্য চকচক করছে। অবশেষে সকাল আটটায় পূর্ব আকাশে দেখা দেয় দিনের প্রথম সূর্য। বছরের প্রথম আলো।