সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব
জাহাজের রেস্তোরাঁয় নানা আকৃতির টেবিল—কোনোটার চারখানা চেয়ার, কোনোটার ছয় আবার কোনোটার চারপাশে বসতে পারে জনা দশেক। সাতপাঁচ না ভেবে চার চেয়ারের একটা টেবিলে বসে পড়ি। তিন বেলায় খাবার পরিবেশনের আগে ঘটা করে রিসেপশন থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়—খাবার তৈরি। একে একে আরও তিনজন আমার টেবিলে এসে বসল। একজন তুর্কি, অন্য দুজন জার্মান। জার্মান দুজনও পরস্পর পূর্বপরিচিত নয়।
জীবদ্দশায় আর কারও সঙ্গে এত দ্রুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। ওদের সঙ্গে হয়ে গেল। জার্মানির ক্যারোলিনের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি গিজগিজ করে। আমরা তার নাম দিলাম হিটলার। এতে সে বেজায় খুশি। জার্মানির আরেকজনের বয়স বেশ কম, নাম সাসকিয়া। বেশ সাধাসিধে। তুর্কি সাইদা পরিচয়ের শুরুতে কামাল আতাতুর্ক নিয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেলল। শিনা টান টান করে প্রিয় খাবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চিবোতে চিবোতে বলল, ‘তুরস্ককে একটি উন্নত, ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে আমার নেতা। তিনি একজন পরিপূর্ণ আধুনিক রাজনীতিক।’ বারবার আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ টেনে বলল, ‘ভাগ্যিস আমরা একজন জাতীয় নেতা পেয়েছিলাম, তা না হলে আধুনিক তুরস্ক পেতাম না। আর এই আমার অ্যান্টার্কটিকা আগমন, সে কেবল দুঃস্বপ্নই হতো না, হতো পাপ!’
আতাতুর্কের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয় সাইদা। তার কথার মর্মার্থ বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। তার কথাকে সমর্থন জানাতে গিয়ে আমরা ইরানের নারীদের স্মরণ করি। এভাবেই আমাদের প্রথম আলাপ। আমরা চারজন। আমরা এক আয়তের চতুষ্কোণ।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ছাড়া আহার শুরুই করতে পারে না সাইদা। শুরুতেই তাই দুই থালি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার করেছিল ও। সেটা দিয়েই আমরা পেট পুরে নিলাম অর্ধেক। সাসকিয়ার ইতালীয় খাবারে বিশেষ আগ্রহ। সে অর্ডার করল স্প্যাগেটি কার্বনারা। এটা একটা ক্ল্যাসিক ইতালীয় পাস্তা ডিশ। স্প্যাগেটি কাঁটা চামচ দিয়ে প্যাঁচাতে তার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সে অতিরিক্ত একটি স্যুপ স্পুন চেয়ে নিল। স্প্যাগেটি পেঁচিয়ে দ্রুত সেটাকে স্যুপ স্পুনে তোলে চট করে মুখে দিয়ে ফেলছে।
খাবার তালিকায় আজ একটি বিশেষ কোরীয় ফুড আছে। আমাদের ‘হিটলার’ বলল, ওই কোরীয় খাবারটিই সে খাবে। জাহাজের বাবুর্চি বারবার সাবধান করার চেষ্টা করল, ভীষণ ঝাল। খাবারের প্রধান পদ তিনটি। তার একটি দেখে আমি ভীষণ পুলকিত। পাঞ্জাবি রুটি আর বেগুন ভাজি। এই দূর মুলুকে এমন খাবার জুটবে স্বপ্নেও আশা করিনি। হিটলার ঘটা করে আমাদের বাঙালি খাবার রীতির প্রশংসা শুরু করল। বলল, বাঙালি রীতিতে সব খাবার সাজিয়ে রাখা হয় টেবিলে, যার যেটা পছন্দ তুলে নিয়ে খায়। সেটা তার বেশ ভালো লাগে।
খাবার শেষে হিটলার আদেশ করল প্রতি বেলায় এই টেবিলেই বসব আমরা। আমরা পূর্ণ সমর্থন দিলাম। আমরা এক আয়তের চতুষ্কোণ।
খাবার শেষ করে কেবিনে এলাম। কেবিন নম্বর ২৫৬। এক হাতের ব্যবধানে দুটি খাট। সরু-নিচু খাট। একজন চিৎ কিংবা কাত হয়ে শুতে পারবে। দুই খাটের মাথার দিকের মধ্যখানে ছোট্ট একটি সাইড টেবিল। তার আছে তিনটা ড্রয়ার। তিন ড্রয়ার দুজনে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করি। তাতে অসুবিধা হয় না কোনো। খাটের পায়ের দিকটায় সামান্য ব্যবধানে বড় একটি ড্রেসিং টেবিল, সেটিও ড্রয়ারে ড্রয়ারে সয়লাব। এত এত ড্রয়ার কেন প্রথমে বুঝতেই পারিনি। আমার কেবিনমেট নাস্তা বলল, ‘বোঝোনি? আর কয়েক ঘণ্টা পরেই তো সমুদ্র দেবতা তার মাতম শুরু করবে, কক্ষের জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছিটকে পড়বে। জড় জিনিসপত্রের জীবন রক্ষার্থে এই পন্থা।’
কক্ষের একপাশে একটা সোফা পাতা, দুজন বসা যায়।
আমার খাটসংলগ্ন জাহাজের দেয়ালজুড়ে পর্দা। পর্দা সরালেই ‘পোর্ট-হোল উইনডো’। ‘পোর্ট-হোল উইনডো’ জিনিসটা হলো বৃত্তাকার কাচযুক্ত জানালা। জাহাজ ছাড়া অন্য কোথাও এমনটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমি পর্দা সরাতে ভয় পাই, ওপাশে কালা পানি। বিমানেই এমনটি আছে, তবে সেটি বৃত্তাকার নয়। সমুদ্র জাহাজের ওপর অনেক চাপ প্রয়োগ করে। বর্গাকার-আয়তাকার জানালা চাপ সহ্যের ক্ষেত্রে দুর্বল। নাস্তা আমাকে জানাল, বৃত্তাকার জানালা শক্তিশালী। ভ্রমণ ব্যবস্থাপনায় আমি তাকে গুরু মানি। সে ১২ রুশ অভিযাত্রীর নেতা।
নাস্তা মুঠোফোনে মুভি দেখছে। আমার চোখে ঘুম নেই। একসময় মুঠোফোন বন্ধ করল নাস্তা।
: তোমার এই পেশাকে তোমার পরিবার কেমন চোখে দেখে, নাস্তা?
-আমার পেশা সম্পর্কে আমার স্বামীকে অনেক আপত্তিকর কথা শুনতে হয়।
: কেমন?
-এই যেমন ধরো, ওর বন্ধুরা বলে তোমার স্ত্রী তো ট্রাভেল এজেন্সি চালায়। প্রতি উইকেন্ডে ঘরের বাইরে থাকে। এ কেমন সংসার তোমাদের? এ বিষয়ে আমার স্বামীর অবস্থান খুব শক্ত। সে উত্তরে বলে, এটা ওর পেশা, কাজটায় সে আনন্দ পায়।
: আমাদের দেশে ভ্রমণ ইদানীং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তাও নগর সমাজে। নারীর একা ভ্রমণ তো এখনো অনেক অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি। এই যেমন আমার কথাই বলি। আমাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়; কেন স্বামী সঙ্গে নেই, কেন আমি একা ভ্রমণ করি, কেন আমার সন্তানেরা আমার সঙ্গে ভ্রমণ করে না। কি করে বোঝাই যে স্বামী-স্ত্রী দুজন আলাদা মানুষ। দুজনের পছন্দ এক না–ও হতে পারে। আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নারী বিদ্বেষী।
-আমি বুঝতে পারছি তোমাকে, মহুয়া। ভ্রমণের শক্তিটা কোথায় পাও, বলো তো? খুব সহজ ব্যাপার তো নয়। সেই বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় এসে, ল্যাটিন আমেরিকা হয়ে অ্যান্টার্কটিকা!
: আমি গ্রামে জন্মেছি, নাস্তা। কিন্তু খুব প্রগতিশীল একটি পরিবারে। সাহিত্য একটি শক্তি। সে চর্চা আমার পরিবারে ছিল। আমাদের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন গদ্য লিখেছেন যিনি, তাঁর নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমার পিতামহ অর্থাৎ বাবার বাবা খুব ভালো বঙ্কিম পড়তে পারতেন। কোনো অভিধানের প্রয়োজন হতো না। পরম্পরায় আমার বাবা ও চাচার মধ্যে সাহিত্যচর্চার ঝোঁক তৈরি হয়েছে। এ চর্চা থেকে প্রগতিশীলতা এসেছে আমার পরিবারে। ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা হয়েছে। আমার সময় থেকে আমার পরিবারকে আমি নারীবান্ধব হতে দেখেছি। আমাদের সমাজে পুত্রসন্তান বেশি সমাদর বা যত্নআত্তি পায় কন্যাশিশুর চেয়ে। আমাদের পরিবারে যেটি আমরা কখনো ঘটতে দেখিনি। বুঝতে পারছ, শক্তিটা কোথায় পেলাম?
কেবিন কক্ষে খুবই ক্ষীণ আলো জ্বলছে। তবু আমি নাস্তার শারীরিক অভিব্যক্তি বুঝতে পারি। সে বিস্মিত হয় আমার মতো অতিসাধারণ এক বাঙালি নারীর বেড়ে ওঠার গল্প শুনে। (চলবে)
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা