অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে অপরূপ ভোর

ছোমরংয়ে রংধনু
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ঢাকার প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে কাঠমান্ডুতে এসে শরীর ও মন—দুই–ই শীতল হয়। তাই বলে মধ্য বৈশাখে এত শীত? দুপুরেই ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বৃষ্টি নামবে। জ্যাকেট পরে ফেয়ারফিল্ড ম্যারিয়ট হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্রাভেল এজেন্সি অ্যামেজিং নেপাল ট্রেকের সন্তোষের সঙ্গে দেখা করি। কাল দুপুরে পোখারায় যাওয়ার ফ্লাইট। সেখান থেকে পরশু ভোরে গাড়িতে নয়াপুল গিয়ে শুরু করব আমার ১০ দিনের ট্রেক। কোন পথ দিয়ে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে যাওয়া-আসা হবে, তার বিস্তারিত কার্যক্রম ও মানচিত্র আমাকে বুঝিয়ে দেয় সন্তোষ। গাইড তেজ বাহাদুর করকি অন্নপূর্ণার সংরক্ষিত এলাকায় ট্রেকিংয়ের পারমিট নিয়ে এসেছে।

৪ মে সকাল সোয়া সাতটায় পোখারা থেকে রওনা হই। নয়াপুল ছাড়িয়ে একটু সামনে বিরেটহাটিতে পৌঁছে আমরা গাড়ি ছেড়ে ট্রেক করতে শুরু করি। জায়গাটা চেনা। আমি আর তেজ এখান থেকেই আগের বছর ঘোরেপানি-পুনহিল ট্রেক শুরু করেছিলাম।

এখন প্রসন্ন নীল আকাশে অল্প মেঘ, কখনো রোদ, কখনো ছায়া। ডান দিকে নিচে শ্বেতী নদী, বাঁ দিকে পাহাড়। শাউলিবাজারে কফি–বিরতির পর খাড়া চড়াই ধরে উঠতে হয় ট্রেকিংয়ের পথে। শেষ বিকেলে ঘানড্রুক পৌঁছে রাত্রিযাপন।

পরদিন সকালে ছোমরংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করি। প্রথম ১০ মিনিট খাড়া চড়াই ধরে উঠি, তারপর ৩০ মিনিট অনেকটা নেমে পুরোনো ঘানড্রুক। এখান থেকে উঁচুতে উঠে কিম্রুংধারা। আবার এক ঘণ্টা উতরাই বেয়ে একটা সবুজ উপত্যকা, একেবারে নদীর কাছে। ঝুলন্ত সেতু ধরে যে নদীটা পার হই, তার নাম কিম্রুংখোলা। নদীর অন্য পারে ক্রমাগত উঁচুতে উঠে দুই ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছাই দুর্বিনধারা।

ট্রেকের নানা জায়গা থেকে দেখা যায় চেনা পর্বতশিখর

সারা সকাল রোদের মধ্যে হেঁটেছি। জ্যাকেট ও ফ্লিসের জামা খুলে শুধু টি–শার্ট পরে হাঁটতেও গরম লাগে। অরণ্যপথে ছায়া আছে। রডোডেনড্রন ছাড়াও আছে বড় বড় ওক। আকাশে মেঘের আনাগোনা। দুপুরের পর শুরু হয় বৃষ্টি—প্রথমে সামান্য, তারপর অঝোর ধারায়। তাতে আমাদের ট্রেকিংয়ে বিরাম নেই। রেইনপঞ্চো পরে হাঁটি। গাছের ওপর থেকে আমার গায়ে বৃষ্টির পানি পড়ে, পাতা ঝরে পড়ে। ট্রেকিংয়ের পথের মাটি ও পাথর ভেজা। পিছলে পড়ার আশঙ্কা আছে। ঝরা পাতার ফাঁকে থাকতে পারে জোঁক। জোঁকের ভয়ে সাবধানে তাকাই, সন্তর্পণে পা ফেলি।

বৃষ্টির পর ঠান্ডা বাড়ে। সাড়ে তিনটার দিকে ছোমরংয়ের গেস্টহাউসে পৌঁছাই। রুমে গিয়ে জ্যাকেট পরে বাইরে আসতে না আসতেই দেখি রোদ উঠেছে। সঙ্গে মিহিন বৃষ্টির ছাঁট। আর আমাদের গেস্ট হাউসের বারান্দার ঠিক সামনে, যেন পাহাড়েরই গায়ে ফুটে উঠেছে অসাধারণ সুন্দর একটা রংধনু। রংধনু আসলে দুটি। ওপরেরটা একটু হালকা আর নিচেরটা উজ্জ্বল। সবাই সেই রংধনুর ছবি তুলছে। কিন্তু ছবিতে ওই স্বর্গীয় দৃশ্য ভালোভাবে ধারণ করা যায় না।

হিমালয়ের প্রকৃতি এমনিতেই অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। তার ওপর পাহাড়ের পটভূমিতে ও রকম জোড়া রংধনু একটা অসামান্য দৃশ্য। রংধনুকে পবিত্র স্বর্গীয় উপহার বলে মানে এখানকার অনেকে। তার ওপর জোড়া রংধনু মানেই শুভ সূচনা, সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির ইঙ্গিত।

এটা শুধু নদী নয়, এবিসির দিকে হেঁটে চলারও পথ

আজকের ট্রেকটা দীর্ঘ

৬ মে ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে সূর্যোদয় দেখি। ভোরের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অন্নপূর্ণা সাউথ, হিউঞ্চুলি, অন্নপূর্ণা ৩ আর বিখ্যাত ফিসটেল। ব্যাগ গুছিয়ে, ব্রেকফাস্ট সেরে সাড়ে সাতটায় পথে নামি। ছোমরং ছিল ২ হাজার ২১০ মিটার উচ্চতায়। আর আজ হিমালয়াতে গিয়ে পৌঁছাব ২ হাজার ৯৫০ মিটারে।

আজকের ট্রেকটা দীর্ঘ। তার ওপর এক দিনে অনেকটা উঁচুতে ওঠা। তবে এভারেস্ট বেজক্যাম্প অথবা গোকিও ট্রেকের তুলনায় এই উচ্চতা তেমন কিছুই নয়। বাঁশ ও বেতবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাই। পথের দুই পাশে অসংখ্য ঝরনা। পাহাড়ের উঁচু থেকে সেই ঝরনার জল ঝিরঝির শব্দ তুলে নেমে আসছে। কোথাও ধারাটি ক্ষীণ, কোথাও স্ফীত জলধারা কলকল স্বর তুলে নেমে আসে। হিমালয়ায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ততক্ষণে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে।

পরদিন ৭ মের লক্ষ্য মচ্ছপুছারে বেজক্যাম্প। প্রথম দেড় ঘণ্টার ট্রেক সুন্দরভাবে সেরে সকাল নয়টায় দেউরালিতে বিরতি নিই। হানি-লেমন চা খাই। সেখান থেকে আধা ঘণ্টা চলার পর দেখতে পাই, বরফধসের সতর্কবাণী। তেজ বলল, কয়েক দিন আগে তুষারধসে বরফ ও পাথর ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাস্তা বন্ধ। এখন আমাদের নিচে নেমে যেতে হবে বিকল্প পথের দিকে।

মোদিখোলা রীতিমতো পাহাড়ি নদী। একেবারে ক্ষীণ নয় তার স্রোতোধারা। নদীর বুকে ছড়ানো ছোট–বড় পাথর। কোনো সেতু ছাড়া শুধু পাথরের ওপর পা ফেলে ফেলে মোদিখোলা নদী পার হয়ে অন্য পাড়ে উঠি। ওপারে কিছু দূর হেঁটে আবার নিচে নেমে নদী পেরিয়ে এপারে ফিরে আসতে হয়। দেড় ঘণ্টা বাড়তি হেঁটে আমরা তুষারধস এলাকাটা পার হয়ে যেতে সক্ষম হই।

সেই ক্লান্তিতে হাঁটার গতি কমেছে। তা সত্ত্বেও দুপুরে খাওয়ার সময় আমরা ঠিকই মচ্ছপুছারে বেজক্যাম্পে পৌঁছাই। আজ আবহাওয়া ছিল দারুণ। সকালে চারদিকে রোদ–ঝলমলে পাহাড়, নীল আকাশ আর দূরের পর্বতশিখর দেখতে দেখতে হেঁটেছি। দুপুর হতেই মেঘ জমছে। বৃষ্টি শুরু হয়। হালকা বৃষ্টির সঙ্গে তুষার। পরে দেখি তুষার নয়, আসলে ঝরছে ছোট ছোট বরফকণা। অনেকটা শিলাবৃষ্টির মতো, শিলাগুলো গুঁড়া গুঁড়া।

কোনো কিছুতেই আমাদের থেমে থাকা চলবে না। দুপুরের খাওয়া সেরে রেইনপঞ্চো পরে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই আমরা আবার ট্রেকিং শুরু করি। ১৫ মিনিট পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসে। আকাশের গায়ে দেখা দেয় মচ্ছপুছারে ও অন্যান্য পর্বতের শিখর। এত কাছে থেকে শিখরগুলোকে রাজসিক দেখায়। এখানে পুরো পথ তুষারাবৃত। পাশেই হিমবাহ, ‘সেথা সাদা বরফের বুকে নদী ঘুমায় স্বপনসুখে’। অন্নপূর্ণা সাউথের হিমবাহের গ্রাবরেখা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে ছোট–বড় পর্বতের শিখরের শুভ্র সৌন্দর্য দেখি।

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে লেখক

আবার তুষারপাত

আগেই ট্রি-লাইন ছাড়িয়ে এসেছি। ঝোপঝাড় বা লতাগুল্মও দেখা যায় না। তবে এই তুষারের রাজ্যেও শুকনা ঘাস আছে, নানা রকম পাখি উড়ে বেড়ায়। তুষারে ঢাকা পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দেয় বাদামি রঙের ইঁদুর—হিমালয়ান পিকা। দেখতে ছোট খরগোশের মতো। তুষারের দেশের বিপন্ন প্রজাতির তৃণভোজী প্রাণী। অনেক দেশেই এগুলো বিলুপ্তপ্রায়। তবে নেপালে এভারেস্ট ও অন্নপূর্ণার আড়াই থেকে সাড়ে চার হাজার মিটার উচ্চতায় এগুলোকে দেখা যায়।

আবার শুরু হয়েছে তুষারপাত। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে, মাইনাস ছয় বা সাত। অবিরাম ঝরে পড়া তুষার জমা হয় আমার টুপি ও সারা গায়ে। তুষারের রাজ্যে ক্রমান্বয়ে উঁচুতে উঠতে থাকি। একসময় দূরে দেখতে পাই রঙিন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজানো একটা সাইনবোর্ড। বিকেল ঠিক সোয়া চারটায় আমি সেই ফলকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ওখানে পৌঁছে যাঁরা ছবি তুলছিলেন, তাঁরা আমাকে ডেকে নেন। একে অন্যকে অভিনন্দন জানাই। সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা: নমস্তে। অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প, এবিসি ৪১৩০ মিটার। ছবি তোলা হয়, যদিও এ রকম মুহূর্ত এমনিতেই অবিস্মরণীয়। তার চেয়েও অবিস্মরণীয় ছিল পরদিনের সূর্যোদয়। অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পের অপরূপ ভোর।