সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব
লাউঞ্জে উপচে পড়া ভিড়। চারদিকে চাপা উল্লাস। রাতের আকাশ দেখার জন্য অভ্যর্থনাকক্ষ থেকে অভিযাত্রীদের ডাকা হচ্ছে। হুড়মুড় করে সবাই লাউঞ্জে চলে আসছে। অন্ধকারে রাতের আকাশ দেখার আয়োজন চলছে।
জাহাজ দুলছে। রাতে যা খেয়েছি, তা আর পাকস্থলীতে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। এক হাত সর্বক্ষণ জাহাজের দেয়ালেই ঠেকিয়ে রাখছি। না হলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা যাচ্ছে না। ডেকে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছি। খুব ঠান্ডা পড়লেও সেটা সইতে পারছে আমার শরীর। বারান্দাটায় তুরস্কের সাইদাকে পেলাম। কাছে গিয়ে বললাম, ‘জানতাম তোমাকে এখানে পাব, তাই এলাম।’ বেচারি ‘মুখাগ্নি’ ছাড়া থাকতে পারে না, তাই নিয়ম করে বেশ কয়েকবার তাকে এখানে আসতে হয়।
আমার কথা শুনে হেসে ফেলল সাইদা। বলল, ‘শরীরটা ঠিক ভালো লাগছিল না। আমাদের জাহাজ ড্রেক প্যাসেজে ঢুকে পড়েছে। আজকের রাতটা কঠিন হবে। তোমার কি এমন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে? ’
বললাম, ‘না, নেই। জাহাজে আগে কখনো রাতই কাটাইনি।’
রাতের আকাশে দু–একটা তারার দেখা মিলেছে, কিন্তু চাঁদ ওঠেনি। লাউঞ্জের পিয়ানোর টুংটাং শব্দ বাইরে আসছে না। ঢেউয়ের আকার দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সমুদ্রের মাতলামি বাড়ছে। দুজনেরই দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে, জাহাজের মেঝেতে বসে পড়ি। হাতে মোজা ছিল না, তাই দুহাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলি। সমুদ্রযাত্রা নিয়েই গল্প শুরু হলো, ‘আমাদের দেশে দুই–আড়াই শ বছর আগেও সমুদ্রযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ছিল।’
: বলো কী? ব্যাপারটা একটু খুলে বলো তো।
–পড়াশোনা শেষ করে সবে তখন ইউরোপ থেকে দেশে ফিরেছি। আবার আমার পুরোনো কর্মস্থলে যোগদান করলাম। আমাকে ধরিয়ে দেওয়া হলো এক বিশেষ দায়িত্ব। জনপ্রশাসনের শুদ্ধাচার নিয়ে একটি গবেষণা করতে হবে। সেটা করতে গিয়েই মূলত কালাপানি বলে একটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। সাগরের পানিকে বলা হতো কালাপানি। সমুদ্রের পানিকে মনে করা হতো বিধ্বংসী। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষের পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষা হতো বিলাতে। দুই কারণে ভারতীয়রা অংশগ্রহণ করতে পারত না। প্রথমত, এটি ব্যয়বহুল। আর একটি বড় কারণ হলো সাগর পাড়ি দেওয়ার বিষয়ে ধর্মীয় বিধিনিষেধ। সমুদ্রের পানিকে মনে করা হতো অমঙ্গলের প্রতীক।
: কিন্তু এমন ধারণা কেন এল?
–দুটি কারণ আমি জেনেছি। একটি ধর্মীয়, অন্যটি রাজনৈতিক। ভারতবর্ষ তো সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। এদিকে বিশ্ববণিকদের নজর ছিল। আর বিশ্ববণিকদের বাহন ছিল জাহাজ, পথ ছিল সমুদ্র। এই পথে বারবার আঘাত আসার কারণে বাঙালিদের সমুদ্রযাত্রায় নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বারবার। এ যেন মাথাব্যথার জন্য মাথাই কেটে ফেলার শামিল। ধীরে ধীরে সমুদ্রযাত্রা একটি গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় অনুষঙ্গ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কালাপানি পাড়ি না দেওয়ার এই লোকাচারে বিশ্বাস করতে শুরু করে। অথচ এর আগে বহু শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষের সঙ্গে নানা মহাদেশের বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল। চীন, আরব, পারস্য ও ইউরোপের অনেক পরিব্রাজকের লেখায় সেগুলো উঠে এসেছে।
মাথা ভালোই ঝিমঝিম করছে। কিন্তু চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। লাউঞ্জে অভিযাত্রীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। সমুদ্রে যেন প্রলয়নৃত্য শুরু হয়েছে। পিয়ানোটা খালি পড়ে আছে। সমুদ্রপীড়া বোধ হয় অন্যদেরও কাহিল করে ফেলেছে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় বলেছেন, ‘ঈশ্বর থাকেন জলে’। আমিও অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে উঠে সেটা বুঝেছি। মনে হচ্ছে, এ সত্যিই কালাপানি, এই পানি বিধ্বংসী!
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি