শ্রীলঙ্কার যে জায়গাটি সেন্ট মার্টিনের কথা মনে করিয়ে দিল

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম পয়েন্ট পেড্রো; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি পয়েন্ট ডন্ড্রা। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। দুই সঙ্গীসহ এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম পয়েন্ট পেড্রো

প্রথম দিন: সাকোটাই কেপ (পয়েন্ট পেড্রো) থেকে কোকোনাট কালটিভেশন বোর্ড, পাচচিলাইপল্লি। দূরত্ব ৩৮ দশমিক ১৫ কিলোমিটার

হোটেল থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। টুকটুকওয়ালা (সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো) বললেন, রাস্তা খারাপ। তাঁর মুখে ‘খারাপ’ শুনে যা ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা আসলে তেমন কিছু নয়। হালকা একটু ঝাঁকি খেয়ে পৌঁছে গেলাম সাকোটাই কেপ। পক প্রণালির তীরে অবস্থিত সাকোটাই কেপ হলো শ্রীলঙ্কার সর্ব–উত্তরের বিন্দু। এখান থেকেই আমরা হাঁটা শুরু করব। এক বালক আমাদের তিনজনের ছবি তুলে দিল। ছবি তোলা শেষে একটু ওয়ার্মআপ করে নিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। ঘড়িতে সময় তখন কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাতটা।

রাস্তায় স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পদচারণ। কিছুটা এগোতেই প্রথম জনপদ পড়ল। এর নাম ইনপারসিদ্দি। সমুদ্রের তটরেখাঘেঁষা রাস্তায় হাঁটছি। রাস্তার ধার ঘেঁষে প্রচুর ম্যাক্সিকান ক্রিপারের লতা। সৈকতে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে গোলাপি এই ফুল। পথে এক ‘মীনকুল-ভক্ত’র বাড়ি পাওয়া গেল। বাড়ির গায়ে ডলফিন, হাঙর এমনকি জলদস্যুদের জাহাজও আঁকা। আচমকা আমার ভাইঝি সানাইরার কথা মনে পড়ে গেল। এর মতো মাছভক্ত শিশু খুব কম আছে। এদিকের বেশির ভাগ বাড়ির গেটেই সুন্দর কারুকার্য। মাতা মেরির ছবিই বেশি, সঙ্গে আছে প্রদীপ হাতে লঙ্কান নারী। কিছুটা এগিয়ে মূল রাস্তা ছাড়লাম। এতক্ষণ বেশ কড়া আর চড়া রোদ ছিল। সেটি থেকে ক্ষণিকের তরে রেহাই পাওয়া গেল।

পয়েন্ট পেড্রোতে বাংলাদেশের তিন অভিযাত্রী

ভিয়াপারিমুলাই থেকে মাটির রাস্তা। জায়গাটা সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় অধিবাসী অধ্যুষিত অলিগলির কথা মনে করিয়ে দেয়। সকাল থেকে অ্যালার্মের মতো একটি শব্দ মাইকে শুনছিলাম। খানিকটা বিরক্তও যে হইনি তা নয়। এত মধুর সকালটাকে তেতো করতে উঠেপড়ে লেগেছে কোন মর্কট? থাম্পাসিদ্দির রাস্তায় এসে সে রহস্যের ধোঁয়াশা কাটল। অ্যালার্মের মতো শব্দে মূলত টুকটুকে করে বেকারি আইটেম বিক্রি হচ্ছে। লোকে সেই শব্দ শুনে বেকারি আইটেম কিনতে ঘর থেকে দৌড়ে চলে আসে। কিরামাকদু থেকে ফের ছোট রাস্তায়। এখানেই দিনের প্রথম মাইলফলকের দেখা পেলাম। যদিও কিলোমিটারে মাপা হয়েছে দূরত্বের হিসাব। এই রাস্তা এগিয়েছে পুলোলির দিকে। রাস্তার ধারেই ময়ূর চরে বেড়াতে দেখলাম। ক্যামেরা তাক করার আগেই উড়ে রাস্তা পেরিয়ে গেল। অবশ্য বেসুরো ময়ূরের ডাক আরও অনেকক্ষণ কানে আসতে লাগল। কী সুন্দর একটা পাখির কী বেসুরো গলা! পথের একপাশে আলোকলতা চোখে পড়ল। হন্টন সঙ্গী উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্র জুমন ভাই এটার বৈজ্ঞানিক নাম বলে খানিকটা জ্ঞান জাহির করল। অবশ্য কাল থেকেই বলছিলেন, ‘বোটানির ছাত্র ছিলাম আমি আর গাছপালা চেনো তুমি!’

মাছভক্তের বাড়ি!

একটি ছোট্ট দোকানে বিস্কুট খেতে গিয়ে কর্ণের সঙ্গে পরিচয়। ১৭ বছর ইউরোপে ছিল সাবেক এই তামিল টাইগার। ভালো ইংরেজি জানে। নিজের পরিচয় দিলেন ‘ফ্রিডম ফাইটার’ হিসেবে। তামিল টাইগারদের নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নাম নিলেন বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গেই। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন তামিল টাইগারের সৈনিক। স্ত্রীর দুই পা-ই হাঁটুর ওপর থেকে কাটা পড়েছে।

ভাল্লিপুরাম থেকে রাস্তার দুপাশ একেবারে ন্যাড়া। শুধু দূরে এক পায়ে দাঁড়ানো তালগাছ দেখা যায়। পথের পাশে যেখানেই অশ্বত্থ, সেখানেই হয় কার্তিক, গণেশ নতুবা হনুমানের মূর্তি। তাঁদের নৈবেদ্যের অভাব হয় না। রাস্তার দুই ধারে ফসলি জমিতে এখনো ট্রাক্টরের ফলা পড়েনি। বৃষ্টি এলেই নাকি ভূমিকর্ষণ করা হবে। জমির মাঝের তালগুচ্ছগুলোর কাণ্ডে বাসা বেঁধেছে অশ্বত্থগাছ। ধীরে ধীরে গ্রাস করছে গাছগুলোকে। তবে এত এত তালগাছে একটিও বাবুইয়ের বাসা নেই। সকাল থেকে খাওয়া হয়নি। মনের খিদের বদলে পেটের খিদের সংস্থান করা জরুরি হয়ে গেছে। সকাল থেকে মাত্র একটিই খাবারের দোকান চোখে পড়েছে। কিন্তু তখন সবে হাঁটতে শুরু করেছি বলে থামিনি। পরের ১১ কিলোমিটারে খাবারের একটি দোকানও পেলাম না। কিডুতথানাইয়ে একটা দোকানে খাবারের ছবি দেখে মনে বড় আশা নিয়ে এগিয়ে গেলাম। হায়! আশায় মরে চাষা! বিশাল দোকানে ছোট্ট একটি তালা ঝুলছে।

চলছে হাঁটা

কিছুদূর এগিয়ে অবশেষে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পড়ল। একখানা অতি কাঙ্ক্ষিত মুদিখানা। ২৮০ টাকা কেজি দরে কলা কিনে খেতে থাকলাম। আম্পানের পর থেকে রাস্তার পাশে অনেক জামগাছ। খাওয়ার লোক নেই। ফলে ফলে কালো হয়ে আছে গাছতলা। পথে পড়ল আম্পানের ডিভিশনাল হাসপাতাল। মাটির টালির ছাদের শান্ত–সমাহিত হাসপাতাল। অবাক করা বিষয় আশপাশে একটা মুদিখানা ছাড়া কিচ্ছু নাই। অন্য কিছু বাদ থাকুক, একটা ফার্মেসি তো হতেই পারত এই জায়গায়!

যাত্রী ছাউনিতে বিরতি

আম্পানের পরে রীতিমতো বিরানভূমি। রাস্তার দুপাশে বড় কোনো গাছ নেই। বাদামি সব ঘাস। গাছ বলতে মটমটিয়া কিংবা বনতুলসীর ঝোপ। নগর কোভিল জাংশনে আর্মি চেকপোস্ট। নাম নিবন্ধনের সময় সেনাসদস্যরা তরমুজ খাওয়ালেন। পাসপোর্টের ছবি তোলার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে আমার অনুমতিও নিলেন! ‘সরি ফর দ্য ট্রাবল,’ বারবার বলছিলেন তরুণ অফিসারটি। এত বিনয় এরা কীভাবে শরীরে ধারণ করে! এবারের পথ মাটির রাস্তা ধরে। গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছিল একটি লেগুনের মধ্য দিয়ে সেতু। বাস্তবে ওটা মাটির রাস্তা। জলাশয় আছে অল্প জায়গাজুড়ে। প্রচুর পানকৌড়ি দেখা গেল অগভীর এই জলাশয়ে। বাকি বিরানভূমিতেও প্রকৃতি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। মনুষ্য নির্মিত কিছুই চোখে পড়ছে না।

মুল্লাই রেস্ট সিটিতে বিশ্রামের জন্য থামলাম না। কারণ খানিক আগেই গাছের ছায়ায় এক দফা রেস্ট হয়ে গেছে। কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু গাছের দেখা পেলাম এলুথুমাত্থুভাম এসে। এখান থেকেই আবার হাইওয়েতে। আমাদের সঙ্গেই সমান্তরালে চলছে রেললাইনের পাত দুটি। কিছুদূর এগিয়ে থামলাম আমিরথাম ভেজিটেরিয়ান হোটেলে। সারা দিনে জুতসই খাবার জোটেনি। রাস্তায় খাবারের দোকানের দুষ্প্রাপ্যতাই অবশ্য এর মূল কারণ। শাকাহারীদের খাবারও যে এমন সময়ে সময়ে মাংসের চেয়েও সুস্বাদু হয়ে ওঠে, এখানে খেতে বসে হাত–মুখে তার প্রমাণ পেলাম। পায়সাম নামের দারুণ একটি পানীয় খেলাম। সাবুদানা, নারকেল আর দুধে বানানো। আমাদের পায়েসের মতোই। তবে এতে তরল ভাব প্রকট।

এখানেই রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে

পথে পড়ল ডি-মাইনিং সাইট। তামিল টাইগারদের পুঁতে রাখা মাইন তুলে ফেলার কাজ এখনো চলমান। ইনথিরাপুরাম থেকে রোদ পুরোপুরি উবে গেল। হাঁটতে খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। পরের জনপদ ইথথাভিল। এখানেই আমাদের আগাপাছতলা কাঁপিয়ে দিয়ে ট্রেন চলে গেল। পালাই নামের জনপদ কনকচূড়ার বিশাল সব গাছে ভর্তি। হলদে ঝাঁকা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে যেন। একটু এগিয়ে সুন্দর একটি যাত্রী বিশ্রামাগারে থামলাম। পাচচিলাইপল্লিতে পেলাম সারা দিনে দেখা একমাত্র বাজার! দোকানপাট, ব্যাংক, বাজার, বাসস্ট্যান্ড মিলিয়ে বেশ সরগরম। পুরো দিনে এমন বাজারের দেখা একবারও পাইনি। মুল্লাইয়াদিতে আরও একটি মাইন ক্লিয়ারেন্স সাইটের দেখা পেলাম। মাইন শুধু যে জীবনের ক্ষতি করেছে এমন নয়, জীবিকারও ক্ষতি করেছে। মাইনের ভয়ে একসময় উল্লেখযোগ্যভাবে এই অঞ্চলে জমি চাষের হার কমে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে বিশাল ভূখণ্ড মাইনমুক্ত হয়েছে নানান বিদেশি সহায়তায়।

নারকেলের দেশে কোকোনাট কাল্টিভেশন বোর্ড পড়ল চোখে। শত শত নারিকেলগাছ সার বেঁধে লাগানো। এই বোর্ডের শেষ মাথায় কোকোনাট কাল্টিভেশন বোর্ডের সার্কিট বাংলো। সকালে এখানে কথা বলে নিয়েছিলাম। যদিও থাকার পরিকল্পনা ছিল আরও চার কিলোমিটার আগের একটা অর্গানিক ফার্মে। ওখানে জায়গা না মেলাতে আরও সামনে এগিয়ে আসা। নিজেরাই ফটক খুলে ভেতরে ঢুকেও কাউকে পাওয়া গেল না। সকালে যে নম্বরে ফোন দিয়েছিলাম, সেটি বারবার রিং হওয়ার পরও ওপাশ নিরুত্তর। অবশ্য বিচলিত হলাম না। এত দিনের পথ হাঁটার অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু জানি কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়েই যাবে। অনেকক্ষণ পর স্কুটিতে একজন এল। মুহূর্তেই বাংলোর পেছনে সে হাওয়া হয়ে গেল। অনেকক্ষণ তাকে গরু খোঁজার পরে পাওয়া গেল স্নানরত অবস্থায়। সে আবার একবর্ণ ইংরেজি বোঝে না। ফোন করে নিয়ে এল আরেকজনকে। তাকে এবার সমস্যা বুঝিয়ে বলা হলো। যদিও তার দৌড় ‘ইয়েস-নো-ভেরি গুডেই’ সীমাবদ্ধ। অল্পক্ষণ পর মিলল চাবি। দারুণ সাজানো-গোছানো সরকারি এই বাংলো। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই মূলত থাকেন। ফাঁকতালে আমাদের ভাগ্যে জুটে গেল ভিনদেশের সরকারি বাংলো। রাতের খাবার নিয়ে খানিকটা চিন্তিত ছিলাম। সুধেনকে ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলায় সে জানাল, স্কুটি নিয়ে আমাদের কাউকে নিয়ে পাশের জনপদ থেকে খাবার নিয়ে আসবে। এবার নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। পথে নামলে একেবারে মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য ভাষা বড় কোনো সমস্যাই নয়। ভালোবাসার ভাষা দুনিয়ার সব ভাষাতেই এক!

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪