৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

উসুয়াইয়া বন্দরে এমভি সি স্পিরিট

আমাদের জাহাজটার নাম এমভি সি স্পিরিট। ২০০ মানুষ ধারণক্ষম। আমরা অভিযাত্রী ১১৪ জন। জাহাজের লোক আছেন আরও ৭২ জন। তাঁদের প্রত্যেকের ভেতরেই একজন ‘গোপাল ভাঁড়’ বসে আছেন। কেন এ কথা বলছি? কারণ, তাঁদের আচরণে, কথাবার্তায় রসবোধ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অভিযাত্রীদের সঙ্গে মজা করার ক্ষমতা তাঁদের বিপুল। এ বিষয়ে তাঁদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে কি না, জানি না। নাকি নিয়োগে রসবোধসম্পন্ন মানুষকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন সবে জাহাজে উঠেছি, অভ্যর্থনার দিকে যাব, দিক বুঝতে পারছি না। একজন ক্রুর কাছে জানতে চাইলাম। তিনি পথ দেখিয়ে দিলেন। সেদিকে গিয়ে আমি আরও দিগ্ভ্রান্ত। পরক্ষণেই তিনি এসে আমাকে বললেন, ‘মজা করলাম। আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। আর হাঁটতে অসুবিধা হলে আমার হাত ধরতে পারো।’

এই রসজ্ঞান তাঁদের শক্তি, দিনের পর দিন পরিবার ছেড়ে পানিতে ভেসে থাকার রসদ, এই ‘জলে ভাসা পদ্ম’ জীবনের সংগীত।

প্রথম আড়াই দিন জাহাজ কেবল পানিতে ভেসে চলবে। কোথাও থামবে না। এ সময়টায় সকাল-বিকেল কয়েক দফায় নানা প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা আছে। অভিযাত্রার ইতিহাস, অভিযাত্রীদের ইতিহাস, প্রাণী-প্রকৃতি, গবেষণা—এমন নানা বিষয়।

জাহাজের অভ্যর্থনাকক্ষ থেকে ঘোষণা এল। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার ইতিহাসের ওপর প্রেজেন্টেশন শুরু হবে। সময়মতো উপস্থিত থাকতে হবে। অভিযাত্রীরা সব লাউঞ্জের দিকে ছুটছেন। আমিও ছুটলাম। জাহাজের লাউঞ্জে এক শর মতো মানুষের বসার জন্য চেয়ার আছে। চেয়ার-টেবিলগুলো শেকলে বাঁধা, জাহাজ দুলবে দুলুক, চেয়ার-টেবিলের নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই।

অ্যান্টার্কটিকায় এমভি সি স্পিরিট

কুককে দিয়ে শুরু করলেন উপস্থাপক। অ্যান্টার্কটিক সার্কেল অতিক্রম করা প্রথম নাবিক ক্যাপ্টেন জেমস কুক। ১৭৭৩ সালে এই কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। এরপর এ পথে গেছেন বহু রথী-মহারথী। এ ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ডের অভিযাত্রী স্যার জেমস ক্লার্ক রস রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিলেন। উত্তর মেরু আবিষ্কার করার পর রসের নজর অ্যান্টার্কটিকার ওপর পড়ে। তাঁর অভিযাত্রী জাহাজের নামেই অ্যান্টার্কটিকায় দুটি আগ্নেয়গিরির নামকরণ করা হয়েছে—টেরর এবং এরেবাস। রসের অভিযাত্রার গল্প একটি সুখী সমাপ্তির গল্প। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে নাইট উপাধি পান।

অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রায় আমার নায়ক দুজন। একজন নরওয়েজীয় অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমুন্ডসেন (১৮৭২-১৯২৮), অন্যজন ব্রিটিশ অভিযাত্রী রবার্ট ফ্যালকন স্কট (১৮৬৮-১৯১২)। অভিযান নিয়ে দুজনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল! অপেক্ষা করছি কখন স্ক্রিনে আসবে তাঁদের গল্প।

অ্যান্টার্কটিকার জীববৈচিত্র নিয়ে অভিযাত্রীদের ধারণা দেওয়া হয়

১৯১১-১২ সালে অভিযানটা হয়েছিল। দক্ষিণ মেরু যাবেন—আমুন্ডসেন এই ঘোষণা দেওয়ার পর স্কটও সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যান্টার্কটিকা অভিযান করবেন। আগেও একবার অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা শুরু করে শেষ করতে পারেননি। দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার কথাটা এবার গোপন রাখলেন স্কট। শুধু জানালেন, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে অজানা অঞ্চলে যাবেন। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘটা করে অভিযাত্রী নির্বাচন করেছেন। এই গোপনীয়তার কারণ আর কিছুই নয়, প্রতিযোগিতা; প্রথম ব্যক্তি হিসেবে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আমুন্ডসেনের মধ্যেও অনেক বিষয়ে এমন গোপনীয়তা রক্ষা করতে দেখা গেছে।

তাই তো স্কট দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে দেখেন সেখানে নরওয়েজীয় পতাকা উড়ছে। স্কটের বুঝতে বাকি রইল না, তাঁর আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন আমুন্ডসেন। আরও করুণ ইতিহাস হলো, এই অভিযান শেষে ফেরার পথেই স্কটের মৃত্যু হয়। অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল আবহাওয়ায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন তিনি। শুধু তিনিই নন, তাঁর দলের বেশির ভাগ অভিযাত্রীই মারা যান।

অ্যান্টার্কটিকায় লেখক

প্রেজেন্টেশন শেষে বেরিয়েই আমাদের দলনেতার মুখোমুখি হলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে চোখ কপালে তুলে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বললাম, প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র, তারপর ব্রাজিল, চিলি হয়ে আর্জেন্টিনায় এসে তোমার এই জাহাজে উঠেছি।

—যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কেন?

—আমাদের দেশে আর্জেন্টিনার কোনো দূতাবাস নেই (আমার ভ্রমণের সময় অর্থাৎ, গত ফেব্রুয়ারিতে, ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস চালু হয়েছে)। আমাদের আর্জেন্টিনার ভিসা করতে হয় ভারতের দিল্লি থেকে। সেটা অনেক সময়সাপেক্ষ। তাই যুক্তরাষ্ট্রে এসে আর্জেন্টাইন কনস্যুলেট অফিসারের অনাগ্রহকে মোকাবিলা করে ভিসা পেয়েছি। তারপর তো অ্যান্টার্কটিকার মতো এমন ব্যয়বহুল অভিযানের ফি পরিশোধ আরেক বড় কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডে ৩০০ ডলারের বেশি পেমেন্ট করা যায় না, কিন্তু অ্যান্টার্কটিকার মতো অভিযানের বুকিং পেমেন্ট তো অনেক অনেক বেশি। স্বাভাবিক কারণেই আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু আর বন্ধুর স্ত্রীর সহযোগিতা নিতে হয়েছে।

এবার তিনি আর শুধু বিস্মিত নন, রীতিমতো স্তম্ভিত। হেসে বললেন, তুমি তো আরেক স্কট, এ যুগের স্কট! (চলবে)