মাদাগাস্কারের রাজধানী আন্তানানারিভোর প্রথম সকালটা যেভাবে কাটল

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব

বাক্সবন্দী সাইকেল দুটো জোড়া দেওয়ার কাজ করতে হলো হোটেলের উঠানে বসে
ছবি: লেখক

আগের দিন সন্ধ্যায় মাদাগাস্কারে পৌঁছেছি। দীর্ঘ যাত্রায় শারীরিকভাবে শুধু নয়, মানসিকভাবেও ক্লান্ত। সাইকেল নিয়ে আজ আর পথে নামব না। তবে বাক্সবন্দী সাইকেল দুটো খুলে দেখা দরকার। তাই সকালের খাবার সেরে হোটেলের উঠানে বসে বাক্স খুলছি। ভয় কাজ করছে, সাইকেলের কিছু হলো কি না!

নাইরোবিতে সাইকেলের বাক্স আমাদের সঙ্গে ছিল না। ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার পর এখন খুলে দেখা হবে। এই পুরো সময়টা আমার মধ্যে একধরনের সূক্ষ্ম চিন্তা কাজ করেছে, সাইকেলের যদি কিছু হয়, যদি কোনো যন্ত্র বাক্স থেকে পড়ে যায়, যদি কোনো স্ক্রু খুলে যায়!

প্রথমে সবুজ, তারপর লাল ট্যান্ডেমের বাক্স খোলা হলো। না, কোনো কিছু খোয়া যায়নি। কয়েক জায়গায় শুধু বাক্স ফেটে গেছে। সে জন্য ঘষার দাগ আছে। তবে এর থেকে বেশি কিছু নয়।

সকালে হোটেলের রেস্তোরাঁটা একেবারে ফাঁকা। গাছে দু-একটা পাখির কিচিরমিচির, এই যা। সাইকেল জুড়ে ফেললাম বিড়ম্বনা ছাড়াই। হোটেলের সামনের হেরিংবন রাস্তায় পরীক্ষা করে দেখলাম সব ঠিকঠাক। খানিকটা এগিয়ে মূল সড়কের ওপরও চালিয়ে এলাম। নিশ্চিত হওয়ার পর হোটেলে সাইকেল রেখে শহর দেখতে বের হলাম পায়ে হেঁটে।

বেলা ১১টাতেও রাস্তায় তেমন প্রাণচাঞ্চল্য নেই

হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে এগোলে ঢাল। ঢালের মাথায় মূল সড়ক। নামটা পড়তেই পারিনি, তবে এই সড়ক ধরে সোজা বাঁ দিকে এগিয়ে গেলে গারে সোয়ারানো রেলস্টেশন পাওয়া যাবে। লক্ষ্য যেহেতু নেই, তাই এই রেলস্টেশনের দিকেই হাঁটা শুরু করলাম।

বেলা ১১টা ছুঁই ছুঁই। কিন্তু রাস্তার প্রাণচাঞ্চল্য বলতে কিছু নেই। চওড়া ফুটপাতের সঙ্গে মুখ করে যে দোকানগুলো, তাদের বেশির ভাগের ঝাঁপ খোলা হয়নি। কতকগুলো কেবল খুলছে। মনে হচ্ছে এই সড়কই শহরের অন্যতম প্রধান সড়ক। দুই পাশের চওড়া ফুটপাতের সঙ্গে যে দালান, তাতে আবাসিক হোটেলের নাম। উঁচু দালান কয়েকটা মাত্র। বাকিগুলো একতলা কিংবা দোতলা। নিচে দোকান, অফিস বা এ ধরনের ব্যবসাপাতি। ফুটপাতে খোলা, টং দোকানে রাজ্যের মোড়কজাত খাবার—বিস্কুট, কেক, চিপস, চকলেট। বোতলজাত পানিও আছে। তবে শহরের গহিনে যে দারিদ্র্য, তা এককথায় বলে দেওয়া যায়। ঘুমন্ত শহর। অলস হাঁটাচলা করছে পথিক। কেউ রোদে বসে আছে। কেউ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ নিজ দোকানের সামনের জায়গা পরিষ্কার করছে। কেউ টংয়ের জোড়াতালি দেওয়া ছাতা লাগানোর চেষ্টারত। কিন্তু সবকিছুরই লয় বড় ধীর। এখানে এসে সময়ের গতি যেন মন্থর হয়ে গেছে।

মাদাগাস্কারের মুদ্রার নাম আরিয়ারি

বিভিন্ন মাপের জেম্বে (ঢোল) নিয়ে বসে আছেন একজন। নাঙ্গা ফুটপাতের ওপর ঢোলগুলোকে দেখে করুণা হলো। একটা তক্তপোশ বা ছালা দেওয়া যেত। পাশেই পান-বিড়ির দোকান। অনেকটা ঢাকার মতোই। কয়েকজন ভবঘুরে বসে আছে। ছেঁড়া কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে নিচ্ছে কয়েকজন।

আরও সামনে এগোলে তিনতলা টানা ভবন। নিচতলায় দোকান। বেশির ভাগই বন্ধ। তিনতলার ছাদে টালি দেওয়া। ক্ষয়ে-খসে গেছে কতক জায়গায়। আড়গুলো বের হয়ে আছে কঙ্কালের মতো। তবে কি এই মন্দাভাব নতুন? কোনো একসময় খুব চালু ছিল? এমন স্থাপনা কেবল জৌলুশপূর্ণ শহরের কথাই মনে করিয়ে দেবে। মনকাড়া ব্যাপার আছে। গাড়ি রাখার জন্য বড়সড় জায়গা ছাড়া আছে। এখন শুধু স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিকি কিলোর এই মার্কেট বা টানা দালান। মন খারাপ করা ব্যাপার। ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর স্বপ্নে ঢাকা। আরেকটু এগিয়ে রেলস্টেশনের সাইনটা দেখতে পেলাম। এবার রাস্তার অপর পারে গেলাম। এদিকের দালানগুলো নতুন। তবে আভিজাত্য নেই। টিকে থাকার জন্য যতটুকু দরকার, তা-ই। নিচের দোকানগুলো গৎবাঁধা। বাজারের গোছের। মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ধীরে। গাড়ির সংখ্যাও। গাড়িগুলো দেখার মতো। পুরোনো সিত্রোঁ, রেনোঁ-ই বেশি। সব ফরাসি কোম্পানির। এই গাড়িগুলোর বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছরের কম না। আমার গাড়ির জ্ঞান একেবারেই কম। আগ্রহও কম। মেক্সিকো সিটির বেশির ভাগ ট্যাক্সিই দেখেছিলাম ভক্সওয়াগনের বিখ্যাত বিটলস মডেলের গাড়ি। ১৯৭৫ সালের এই নকশা এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে ঢাকাতেও এর অন্ধভক্ত আছে। ২০০০ সালের শুরুর দিকে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত এই বিটলস গাড়ি নিয়ে ভ্রমণের চল হয়েছিল। আমার পরিচিত দুজন করেছিলেন বলে জানা। আরও কয়েকজন জান দিয়ে দিতেন তাঁদের বিটলসকে সচল রাখার জন্য। বিটলস জার্মানির গাড়ি। এখানে সব ফরাসি। উপনিবেশের ফজিলত। শোষণ শেষে ছোবড়া হিসেবে যা ছিল, তা-ই এখনো পড়ে আছে। পুরোনো গাড়ি আদতে শৌখিনতার প্রতীক হলেও এখানে জীবিকার যন্ত্র মাত্র। বান্দরবানের চান্দের গাড়ির মতো। বিখ্যাত জিপ কিংবা ডিফেন্ডারগুলো আজও আমাদের বয়ে নিয়ে যায় থানচি কিংবা সাঙ্গু নদের কোলের রুমা বাজারে।

দুপুরের খাবারের জন্য রাস্তার ধারের এক রেস্তোরাঁ বেছে নেওয়া হলো। গতানুগতিক খাবার জায়গা। একটা টানা বেঞ্চ। তার সামনে প্লাস্টিকের টেবিল, সঙ্গে দুটো করে প্লাস্টিকের চেয়ার। সাদা দেয়াল। স্থাপনাটা অতীতে হয়তো রেস্তোরাঁ ছিল না। দেখে আমার তা-ই মনে হচ্ছে। পুরোনো দালানে ইট-সুরকি যেমন ঠান্ডা ধরে রাখে, এখানেও তা-ই হচ্ছে। বেশ আরামপ্রদ ঠান্ডা। বাইরে রোদ আছে কিন্তু গরম লাগার মতো নয়।

বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের অর্ডার দেওয়া হলো। আমার আলুভাজি হলেই চলত। কিন্তু বার্গার কেমন হবে, জেনে নেওয়া ভালো। সামনের দিনগুলোতে খাওয়ার জন্য এই জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। নতুন জায়গায় প্রথমে পরিচিত খাবার খাওয়াটাই উত্তম। পরে অন্য কিছু দেখা যাবে।

মাদাগাস্কারের মুদ্রার নাম আরিয়ারি। ডলারের বিপরীতে মান অনেক অনেক কম। বাংলাদেশি ১০০ টাকায় প্রায় চার হাজার আরিয়ারি। খাবারের দামও কম। চারজনে ভরপেট খাওয়া, সঙ্গে একটা করে কোল্ড ড্রিংকস দেড় হাজার টাকায় সারা। খাওয়াজনিত সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না। বার্গারটা যত না ভালো ছিল, তার চেয়ে ভালো ছিল মাংসের পেটিটা। মালাগাছি আলু যেমন সুস্বাদু, এদের গরুর মাংসও যে ভালো হবে, তা বুঝতে পারলাম। দামে, মানে, স্বাদে সব দিক বিবেচনায় খাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।

হোটেলে ফিরে এলাম। বিকেলে নানহানতা আসবেন। ডলার ভাঙাতে সাহায্য করবেন। এখানে ডলারের প্রতি মানুষের আগ্রহ অপরিসীম। সামনের ১০ দিনের জন্য ডলার ভাঙিয়ে নেওয়াই উত্তম মনে হলো। রাজধানীর অভিজাত এলাকাই যদি এমন হয়, তবে সামনের দিকে কী থাকছে, তা অনুমেয়। তাই রিস্ক নেওয়া যাবে না। ১০ দিনের জন্য যে পরিমাণ ডলার ভাঙাতে হবে, তা মাদাগাস্কারের ছোটখাটো মানি এক্সচেঞ্জের জন্য বেশি হয়ে যাবে। আবার এই পরিমাণ টাকা নিয়ে বাজারের দিকে যাওয়া নিরাপদ নয় বলে নানহানতা নিজে আসতে চাইলেন।

নানহানতা চারটার দিকে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। মোট পরিমাণকে আধাআধি করা হলো। তাঁদের পরিচিত দুই দোকান থেকে বদলে নেওয়া হলো। অনেক টাকা। পরিমাণ আর মূল্যমান দুটোতেই। নোটগুলোও বড় বড়। স্থানীয় একটা সিম নেওয়া হলো। সঙ্গে ম্যাপ। ম্যাপের দরকার পড়বে না তেমন। রাস্তা একটাই। গুগল ম্যাপ প্রিন্ট করে নেওয়া আছে। তার পরও বিপদ-আপদে প্রয়োজন হলে নানহানতাকে যেকোনো সময় পাওয়া যাবে এই আশ্বাস দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।

শেষবারের মতো সাইকেলটা চেক করে ঘুমাতে এলাম।

কাল খুব ভোরে রওনা। (চলবে)