পথে ময়ূর দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছি

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন দ্বাদশ পর্ব।

কৃত্রিম দ্বীপের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে প্রকাণ্ড বুদ্ধমূর্তিটি

দ্বাদশ দিন: মাহিয়ানগানায়া থেকে থাল্ডেনা। দূরত্ব: ৩৮.৮২ কিলোমিটার।

সকাল শুরু হলো মাহিয়ানগানায়া শহরের ফুটপাতে লুটিয়ে থাকা শিউলির শুভ্র চাদর দেখে। শরতের এই ফুল মানেই তো দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা। মাহিয়ানগানায়া ন্যাশনাল স্কুলের সামনে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের ভিড়। ক্লক টাওয়ার থেকে ডানের রাস্তা নিলাম এবার। এই রাস্তা নিয়ে যাবে মাহিয়ানগানায়া রাজমহা বিহারে। এগোতেই পাশে আবার পড়ল মহাওয়েলি গঙ্গা নদী। শ্রান্ত পথিকের মতো ধীরলয়ে বয়ে যাচ্ছে। বিপরীতেই রাজমহা বিহার। প্রাত্যহিক পূজাপার্বণ শুরু হয়েছে কেবল। প্রাঙ্গণে ব্যস্ত হাতে ঝাঁট দিচ্ছেন কর্মীরা। এখানেও চত্বর বাঁধানো বিশাল বোধিদ্রুম আছে। আর আছে প্রাচীরে হাতির শুঁড়ের পাহারাসমেত সাদা স্তূপা।

বিহার প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে উইল্লুওয়া বুদ্ধমূর্তি। কৃত্রিম একটা দ্বীপের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে প্রকাণ্ড বুদ্ধমূর্তিটি। ‘ভগবান’ তথাগত দাঁড়িয়ে আছেন পদ্মপাতার ওপরে। এটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে উঁচু দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি। ১০২ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে মাত্রই গত বছরে। ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের জোড়া শহর হায়দরাবাদ আর সেকেন্দ্রাবাদকে পৃথক করে রাখা হোসেন সাগরের জলে এ রকম দ্বীপের মাঝে দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি দেখেছিলাম। কৃত্রিম দ্বীপকে কেন্দ্রে রেখে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় রাজমহা বিহারের স্তূপা আর বিশাল বুদ্ধমূর্তির ছায়া পেয়ে গেলাম জলাশয়ের জলে।

সকাল থেকে ময়ূর দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত। আমাদের দেশে যেমন কাক, এই দেশে তেমন ময়ূর! খেত থেকে আসা উৎকট শব্দ শুনলেই ওদিকে তাকিয়ে ময়ূরের দেখা পাওয়া যায়। এই পাখির ভিডিও ভালো, অডিও খারাপ! যে ছোট্ট সড়কটি ধরে চলছি, এর নাম সি-৬০২। অবশ্য ময়ূর সড়ক বললেও অত্যুক্তি হবে না মোটেও। বেশ কয়েকটা ব্রেডফ্রুট গাছ পেলাম। বেশির ভাগ বাড়ির একচিলতে উঠোনে অলকানন্দার হলদে ঔজ্জ্বল্য। অতিকায় সব কাঠগোলাপ গাছও আছে পথের পাশে।

খাবারের খোঁজে ময়ূরের দল

রাস্তার ধারে ছোট একটা দোকান দেখে সকালের নাশতা সারতে বসে পড়লাম। আমার প্রথম পছন্দ শাকাহারী খাবার। অন্যদিকে জুমন ভাই মাংসপ্রেমী। মুসলিম দোকান পেয়ে এই ভ্রমণে প্রথমবারের মতো প্লেটে গরুর মাংস তুলতে তুলতে বলল, ‘এত সুস্বাদু একটা জিনিস খাবি না?’ জীবনের কোনো একপর্যায়ে শাকাহারী বনে যাওয়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছে আছে। কিন্তু মায়ের হাতের রান্না করা গরুর মাংস পাতে তুলতে পারব না মনে পড়লেই সেই ইচ্ছেটা ঝাঁকি খায়!

মাপাকাদাওয়েয়া নামক এই জনপদ মুসলিম–অধ্যুষিত। ছোট রাস্তায় হাঁটার কারণেই সম্ভবত লোকে অসংখ্যবার থামাচ্ছে। ‘আবিদিনেবা’ শব্দটি উচ্চারণ করে তাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করছি। সিংহলা এই শব্দের অর্থ হাঁটা। পাংরাগাম্মানাতে মুসলিম বিদ্যালয় আছে একটি। চেয়ারকে উইকেট বানিয়ে একদল ছেলে ক্রিকেট খেলছে। আজকের দিনের প্রথম বড় বাজার পেলাম এখানে।

কৃষ্ণচূড়াগাছের পাতার মতো দেখতে ক্যাশিয়াগাছের ঝিরঝিরে পাতায় হাওয়ার শব্দ মনপ্রাণ দুই জুড়িয়ে দিচ্ছে। রাস্তার পাশের নিচু জলাশয়ে একসঙ্গে বেশ কিছু কালাগলা মানিকজোড়ের দেখা পাওয়া গেল। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এই রাস্তা আমাদের এই পদব্রজে ভ্রমণে বেশ সামনের সারিতেই থাকবে। পরের জনপদ ডাবাগোল্লা। কিছুদূর এগিয়ে সুন্দর একটা খাল পড়ল। বোল্ডারসমেত জলের ধারাটি আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের খাল কিংবা ঝিরির মতোই। একটা স্কুলের সামনে একদল শিশু আমাদের দূর থেকে দেখেই চিৎকার শুরু করে দিল। সমস্বরে হাত নাড়তে নাড়তে ‘বাই, বাই’ শুনতে গিয়ে কান ঝালাপালা। এগিয়েই শ্রী গঙ্গারামা বিহার; মূলত বৌদ্ধস্তূপ। অন্যান্য সব বৌদ্ধস্তূপের মতোই গঠন।

পথের পাশে বালিশের দোকান

পা চালিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রাকৃতিক হ্রদ লোজ্ঞাল ওয়ায়। এই জলাধারের ঠিক পেছনেই পাহাড়সারি আর একপাশ ঘেঁষে রাস্তা। পাহাড়গুলো লেকের স্বচ্ছ জলে মুখ দেখতে ব্যস্ত যেন! চারপাশের দৃশ্য অসম্ভব মনোলোভা। কিছুদূর এগিয়ে এই পথ মোহনীয় বাঁক নিয়েছে। হাঁটতে দারুণ লাগছে। জলাধার থেকে চোখ সরছেই না আমাদের। মনে হচ্ছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে উঠে আসা দৃশ্য। জলাশয়ের শেষ মাথায় জল নিয়ন্ত্রণের জন্য স্পিলওয়ে। মহাওয়েলি গঙ্গার একটা শাখাকেই মূলত রূপান্তর করা হয়েছে বিশাল এই জলাধারে। অল্প এগিয়ে এবার উঠে পড়লাম বি-৩৬ নম্বর রাস্তায়। রাস্তার মোচড়ের শেষ মাথায় বুদ্ধানকোট্টা মন্দির। গেরুয়া পরা বুদ্ধ বসে আছেন। এগিয়েই রাজামাওয়াথা জংশন। এখানেই চায়ের জন্য থামা হলো। এই রাস্তা চলে গেছে বাদুল্লার দিকে।

হাওয়ানদানা ছাড়িয়ে কারামেতিয়া। পথের পাশে প্রচুর ব্রেডফ্রুটগাছ। রাস্তার পাশের দোকানেও ঝুলছে এই ফল। খানিক এগিয়ে জয়াসুমানারামায়া বিহার পড়ল একটা বিশাল টেক্সটাইলের সামনে। পরের জনপদ বালাগোল্লা। এরপর রাস্তার ধারে অনেক বালিশের দোকান। সঙ্গে বালিশের কাঁচামাল তুলাও বিক্রি হচ্ছে এন্তার। হাতের বাঁয়ে বিশাল এক পাহাড়সারি। রীতিমতো কুমিরের সাইজের একটা গুইসাপ পেলাম রাস্তার পাশে। পরের জনপদ ১৬ মাইল পোস্ট। এই রাস্তায় মাইল পোস্টের নামে অনেকগুলো জনপদ আছে। অনেকটাই আমাদের দেশে ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুরের মহাসড়কের মতো ব্যাপার। কিছুটা এগিয়ে মিগাহাকিউলা পড়ল পথে। সাইনবোর্ড জানাল আমরা আছি সমুদ্র সমতল থেকে ৩২৭ মিটার উচ্চতায়। মিগাহাকিউলা ছোট্ট, ছিমছাম জনপদ। হাসপাতাল, ব্যাংক, দোকান, সরকারি অফিস, বিদ্যালয়-ছোট্ট গঞ্জের নানান অনুষঙ্গ নিয়ে এই জনপদ। শেষ মাথার একটা দোকানে দুপুরের খাবার খেলাম। শ্রীলঙ্কায় খাওয়া অন্যতম সেরা ভেজ মিল। ধুন্দল আর পেঁয়াজ ভাজার স্বাদটা জিহ্বা অনেক দিন মনে রাখবে নিঃসন্দেহে। আজ রাস্তায় প্রচুর চড়াই-উতরাই। দুপুরের খাবারের পর সেটা আরও বাড়ল। বিশাল সব চড়াই। একটা চড়াইয়ের মাথায় উঠলে অপেক্ষা করে আরও একটা চড়াই।

পাথুরে পাহাড় ঘেঁষা সড়ক

রাস্তার এক পাশে পাথুরে পাহাড়। অন্য পাশে বিশাল খাদ। খাদের ওপারের পাহাড়গুলোর মাথায় কালো মেঘের ছায়া। এই পাহাড়ি রাস্তায় চড়াই ভেঙে উঠতে দেখলাম একটা গরুর গাড়ি। দুটো গরু আছে সামনে, একটা আবার আছে পেছনে। ওই তিন গরু আর আমরা দুজন ছাড়া আর কাউকে হাঁটতে দেখা গেল না! সবাই কোনো না কোনো বাহনে চড়ছে। ডানের খাদে এবার সঙ্গী হলো বাদুলু ওয়া নামে নদী। পাহাড়ের রাস্তা থেকে ছোট কিছু রাস্তা গিয়ে মিশেছে নদীর ধারের পাড়ায়। দেখতে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাড়াগুলোর মতোই। এখানের পাহাড়ি জমিতে ধাপ চাষও নজরে এল। পরের জংশন ১২ মাইল পোস্ট। বাদুলু ওয়াকে এতক্ষণ দেখছিলাম দূর থেকে। কিছুটা এগিয়ে এই নদীকে পাওয়া গেল একদম পথের পাশেই। উপত্যকার মধ্য দিয়ে পথ করে চলছে তীব্র বেগে।

কালুপালামাতে বাদুলু ওয়ার ওপর নির্মিত সেতু পেরোলাম। পলির ভারে নদীর পানি ঘোলা। ১০ মাইল পোস্টের কাছের বিহারে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে। খানিকটা এগিয়ে পাহাড়ের ধাপে ভুট্টার খেত। ধাপে ধাপে একদম পাশের পাহাড়টার চূড়ায় উঠে গিয়েছে। থাল্ডেনাতে এসে আজকের মতো জুতো তুলে রাখলাম। (চলবে)

আগের পর্ব