আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব

জাহাজের ভেতরে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

জাহাজে দুটি লাউঞ্জ। তিনতলার লাউঞ্জটিতে নানা ধরনের উপস্থাপন, সিনেমা প্রদর্শন, বক্তৃতা চলতেই থাকে। আর চারতলার লাউঞ্জটা পানশালা। অভিজাত বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এক কোনায় পাতা আছে একটি পিয়ানো। রবীন্দ্রনাথের আর্জেন্টাইন অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর পিয়ানোটা দেখতে যেমন, ঠিক তেমন। আরেক পাশে কফির আধুনিক সরঞ্জামাদি। নানা ঢঙের কফি। সবটা আমি বুঝিও না ঠিকমতো। পাশেই কাপ-পিরিচ সাজানো আছে। পাশে ছোট্ট একটা টেবিল পাতা, তাতে নানা পদের কুকিজ। ব্যাংক কিংবা টেলিকমিউনিকেশন অফিসের কাস্টমার কেয়ারের মতো এটি ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অভিযাত্রীদের এরা অ্যান্টার্কটিকার পানি কিংবা বরফে না মারলেও খাইয়ে মারবে।

কফির কাপে চুমুক দিলাম। কফির ধোঁয়া আমার মুখ আলিঙ্গন করছে। আমি আরাম পাচ্ছি। সাগর এখন শান্ত। তবে অশান্ত হওয়ার পাঁয়তারা করছে। লাউঞ্জের পাশে কাচ দিয়ে ঘেরা আর একটি অতি ক্ষুদ্র কক্ষ আছে। সেখানে কয়েকটি বইয়ের তাক আর বসার ব্যবস্থা। এ অভিযাত্রায় সবচেয়ে রাশভারী অভিযাত্রীরা সেখানে গিয়ে বসে। বইয়ের পাতায় স্থির তাদের দৃষ্টি। জগৎ–সংসারের আর কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।

শিকলে বাঁধা চেয়ার

অভিযাত্রীদের সবচেয়ে বড় দলটি রুশ। এক দেশ থেকেই তারা এসেছে ১২ জন। সবচেয়ে ছোট দল চীনাদের। মাত্র দুজন। তাদের জন্য সব ঘোষণা চীনা ভাষায় অনুবাদ করে বলা হয়। জার্মানরাও সংখ্যায় কম না। তবে তারা বিচ্ছিন্নভাবে এসেছে। রুশদের মতো দলে দলে হাঁটে না। তাদের হয়তো কেউ কেউ ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ্য নয়। সব ঘোষণা পরপর চার ভাষায় হয়: ইংরেজি, জার্মান, রুশ এবং চীনা।

প্রথম দিন রাতের খাবারের সময় পাশের টেবিলের এক নারীর দিকে দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল। চেহারায় ভারতীয় ছাপ। চোখ কাজল কালো। পেছনের মাথার লম্বা চুল সরু হতে হতে ঘোড়ার লেজের মতো হয়েছে। চুলে কৃত্রিম কোনো রং মাখানো নেই। আজকাল যেমন পয়সা খরচ করে কালোকে সাদা করার একটা চল যাচ্ছে। আমার মতো গায়ের রং। সাগ্রহে পরিচিত হলাম। তিনি জেফ্রিন (ছদ্মনাম)। বিয়েথা করেননি, দুই বান্ধবী একসঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রায় বেরিয়েছেন। বললেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মেছেন। সেখানেই স্থায়ী। মা-বাবা ভারতীয়। ভাব হতে সময় লাগল না। দূর মহাদেশে কোনো ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে পেয়ে বাড়ির পাশের কাউকে পাওয়ার অনুভূতি জাগল। ভাব-ভালোবাসায় আমার চেয়ে এক কাঠি সরেস জেফ্রিন। চট করে তার মাকে ভিডিও কল দিয়ে বসল। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। আমার এ অভিযাত্রা তাকেও খানিকটা গর্বিত করেছে বলে মনে হলো। একই পদ্মা-গঙ্গার পারেই তো বেড়ে উঠেছে আমাদের পূর্বপুরুষ। তার কিছু প্রভাব তো পরম্পরায় বইবেই।

অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সময় জাহাজে লেখক

আরেক ভারতীয়েরও দেখা পেয়েছিলাম। তিনি ব্রিটেনে থাকেন। ব্রিটিশ স্বামীর সঙ্গে বেশ গর্ব করে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই জুটির সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমার একটা বাড়তি পাওনা হলো। বিদেশি দুলাভাইকে ঝটপট আমার ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে আবদার করে বসি—খিছ মেরে ফটো!

ঢেউয়ের দোলায় কোনো চেয়ার এখানে সরে পড়ে না। তারা সবাই শিকলে বাঁধা। স্থানচ্যুতিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। পরস্পরের হাত ধরাধরি করে থাকে। কেউ একজন পিয়ানো বাজাতে গিয়ে পিয়ানোকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে কিন্তু ঠিকঠাক পেরে উঠছে না। মনে হচ্ছে সে নিতান্তই নবিশ। তাকে ডিঙিয়ে আমি জাহাজের একদিকের ডেকে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

ভাবছি এ জগতের কত অনুসন্ধান, বাণিজ্য, যুদ্ধ, অভিবাসন, উপনিবেশ আরও কত–কিছুরই না সাক্ষী এই জাহাজ। পৃথিবীতে কোনো অভিযানই শুরু হতো না, যদি জাহাজ তৈরি না হতো। আজ আকাশপথে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময় আবেগে আমরা কাঁপতে থাকি, আর জাহাজে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন কলম্বাস! ভাস্কো–দা–গামার আসা-যাওয়ার মাশুল তো আমাদের কম গুনতে হয়নি। আজ থেকে ৫০০ বছরের বেশি আগে ভারতের কালিকট বন্দরে ভিড়েছিল গামা সাহেবের জাহাজ। প্রথমবার কালিকটের রাজা জামোরিনকে তুষ্ট করতে পারেননি গামা। দ্বিতীয়বার আবার এসেছিলেন কয়েক গুণ শক্তিসামর্থ্য নিয়ে। নিজের দুঃসাহসের নমুনা হিসেবে বেশ কিছু ভারতীয় জাহাজ আটকে ক্রুদের হাত-নাক-কান কেটে রাজার কাছে পাঠান গামা। আহ্‌, কী নৃশংসতার দৃষ্টান্ত! আমার কাছে জাহাজ মানে সব সময় বীরত্বগাথা নয়। আমার কাছে জাহাজযাত্রা মানে কখনো কখনো কলঙ্ক। আমাদের এই অভিযাত্রায়ও দুঃসাহসিক, তবে এ পৃথিবীর কারও জন্যই সে হানিকর নয়। এ অভিযাত্রা অনুসন্ধানের। এ অভিযাত্রা জীবনের জয়গানের।

নিত্যকার সূর্য অস্ত গেছে কবেই। আকাশের প্রতিদিনের কিছু তারা জেগে আছে। এই আকাশটা আমার চেনা। ঢাকার আকাশের মতো। পার্থক্য শুধু ইট-পাথরের ঢাকায় আকাশটা ঠিকঠাকমতো দেখা যায় না, এখানে সে বাধা নেই। আবহাওয়া এখনো আমাদের অনুকূল। এখনো কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা সে করেনি। অভিযাত্রীরা আনন্দে ভাসছে। জাহাজ ছুটছে। পেছনে তার তরঙ্গরাশি ফুলেফেঁপে উঠছে। আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি। (চলবে)