চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগের একটি বাণিজ্যকেন্দ্র ও বসতির খোঁজ পেয়েছেন একদল প্রত্নতাত্ত্বিক। যেসব প্রত্নসামগ্রী নিয়ে গবেষণা করে এই খোঁজ তাঁরা পেয়েছেন, সেগুলোর সংগ্রাহক রহনপুরের মাহির ইয়াসির। তাঁর সংগ্রহের খোঁজ নিলেন সজীব মিয়া
‘আজকের অনুষ্ঠানের যে রিয়েল হিরো (সত্যিকারের নায়ক), যার কালেকশনের (সংগ্রহ) ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণা, সে হলো মাহির ইয়াসির।’
এটুকু বলে মিলনায়তনে দর্শকসারিতে মাহিরকে খুঁজতে থাকেন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। জোর করতালির মধ্যে দর্শকসারিতে বসে থাকা আড়ষ্ট মাহির ওঠে দাঁড়ান। মঞ্চে ডাকলে সসংকোচ হেঁটে গিয়ে অতিথিদের সঙ্গে বসেন।
সেটি ছিল ‘রহনপুর: বরেন্দ্রভূমির প্রবেশদ্বার’ শীর্ষক বিশেষ বক্তৃতা অনুষ্ঠান। যেখানে গবেষণায় পাওয়া নিদর্শন ও পদ্ধতি তুলে ধরেন গবেষকেরা। ১১ মের সেই আয়োজনে রহনপুরের মাটিতে পাওয়া দুই শতাধিক সংগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন মাহির। সেসব এশিয়াটিক সোসাইটির অঙ্গনে প্রদর্শন করেন তিনি।
মাহির ইয়াসিরের কাছে পুরোনো ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, ছাঁচে-ঢালা তাম্রমুদ্রা, মৃৎপাত্র, পাথরের পুঁতি, মাটি ও পাথরের মূর্তি, নানা আকৃতির পাথরের বাটখারাসহ প্রাচীন নানা প্রত্ননিদর্শন আছে। এসব নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একদল শিক্ষক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। পাশাপাশি রহনপুরেও কাজ করেছেন তাঁরা। দেড় বছর গবেষণার পর প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলছেন, রহনপুরে দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো একটি বাণিজ্যকেন্দ্র ও বসতি ছিল। এই প্রত্ন–অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা ও বসতিরও প্রমাণ মিলেছে।
কিন্তু মাহিরের কাছে এসব কীভাবে এল? সে গল্প শোনাতেই আমাদের আহ্বানে ১২ মে প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন এই তরুণ।
বাড়ির সিন্দুকে প্রাচীন মুদ্রা
মাহির ইয়াসিরের প্রপিতামহীর একটি সিন্দুক ছিল। একদিন বাড়িতে খুব ঘটা করে খোলা হয় সেই সিন্দুক। বড়দের সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মাহিরও সেখানে ছিলেন। সিন্দুক খোলার পর পাওয়া গেল কিছু মুদ্রা। তাঁর দাদার মা জমিদার পরিবারের মানুষ ছিলেন। মুদ্রাগুলো তিনিই সংরক্ষণ করেছিলেন। একসময় মুদ্রাগুলো মাহিরের হাতে আসে।
একসময় মুদ্রা সংগ্রহের প্রতি মাহিরের আলাদা ঝোঁক তৈরি হয়। বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে আনিয়ে নিতেন সেসব দেশের পুরোনো মুদ্রা। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর শুরু করেন ভারতীয় উপমহাদেশে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মুদ্রার খোঁজ। এভাবেই অনেক সংগ্রাহকের সঙ্গে পরিচয়।
দিনে দিনে মুদ্রার পাশাপাশি নানা কিছু সংগ্রহের বাতিক পেয়ে বসে। দেশলাই বাক্স, হুঁকা, ক্যামেরাসহ পুরোনো যা পান, তা–ই সংগ্রহ করেন।
অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর মহাস্থানগড় ও উয়ারী-বটেশ্বরের ইতিহাস পড়ে রহনপুরের অতীত নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন। জানতে পারেন, তাঁর স্কুল রহনপুর আহম্মদী বেগম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠটিও একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট। পুনর্ভবা ও মহানন্দা নদীকে কেন্দ্র করে তাঁদের এলাকার সমৃদ্ধির কথাও ইতিহাসে পড়েছেন। সেই ইতিহাসের সন্ধানে নেমে পড়েন মাহির।
লক্ষ্মণ সেনের অট্টালিকা বলে পরিচিত নওদা বুরুজ (ঢিবি) তাঁদের বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার। প্রায়ই সেখানে ছুটে যেতেন মাহির। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন আশপাশের এলাকা। মাহিরদের বাড়ির কাছেই মহানন্দা। বৃষ্টি হলেই নদীপাড়ের মাটি সরে বের হয়ে আসে নানা রকম মৃৎপাত্র। সেসব সংগ্রহ করেন। আবার এলাকার কোথাও নতুন বাড়ি তৈরি হবে, খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন মাহির। কিছু বের হলেই সংগ্রহ করেন।
আস্তে আস্তে এলাকার লোকজনও মাহিরের আগ্রহের কথা জেনে যায়। অনেকেই মাহিরকে ডেকে হাতে তুলে দিতে থাকেন পাথরের পুঁতি, বাটখারা বা মৃৎপাত্র। কোনো কোনোটা ৫–১০ টাকায় কিনেও নিতেন। সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঁকা কথাও শুনতে হয়েছে অনেক—‘পাগল হয়েছ নাকি, এসব ভাঙারি কুড়িয়ে বেড়াও’, ‘ছোট বাচ্চাদের জিনিস কেন কেনো’ ইত্যাদি! ‘তবে বেশির ভাগ মানুষই আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন।’ বললেন মাহির।
সংগ্রহ করেই বসে থাকতেন না মাহির; কী সংগ্রহ করেছেন, কতটা গুরুত্বপূর্ণ এসব, জানার চেষ্টা করতেন। যেমনটি মাহির বলছিলেন, ‘একটি ইটের টুকর কুড়িয়ে আনলেও সেটা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। জিনিসটি কখন বানানো, কী কাজে ব্যবহার হয়েছে, এসব খুঁজে বের করা আমার নেশার মতো। তাই আমার প্রতিটি সংগ্রহ নিয়ে জেনেছি। নিজে চেষ্টা করে উদ্ধার করতে না পারলে গবেষকদের শরণাপন্ন হয়েছি। দেশে ও ভারতের দীপান ভট্টাচার্যসহ কয়েকজন গবেষকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। ফেসবুকেও অনেকে আমার সঙ্গে যুক্ত। কোনো ছবি পোস্ট করলে সেটা সম্পর্কে তাঁরা মন্তব্য করেন, তথ্য দেন।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের সঙ্গেও এভাবেই মাহিরের পরিচয়। তাঁরা গবেষণার আগ্রহ প্রকাশ করলে নিজের সংগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসেন মাহির। মাঠপর্যায়ের কাজেও সহায়তা করেন তিনি।
রহনপুরে হবে মাহিরের জাদুঘর
মাহির ইয়াসিরের সংগ্রাহক জীবনের অন্যতম উৎসাহদাতা তাঁর ব্যবসায়ী বাবা শরিফুল্লা আল মোবারক। কলেজ-অধ্যক্ষ মা রেহানা সুলতানার অনুপ্রেরণাও কম পাননি। আর মা-বাবা দুজনের সমর্থন পেয়েছেন প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছেন মাহির। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পড়ার স্বপ্ন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সেই সুযোগ এবার পাননি। আপাতত তাই রাজশাহী কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েছেন। এখন দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন।
ঢাকায় তাঁর প্রত্নসামগ্রী প্রদর্শনের খবর পত্রপত্রিকার মাধ্যমে এরই মধ্যে রহনপুর এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। মাহির বলেন, ‘এখন আমার অন্যতম কাজ হবে এলাকার মানুষকে সচেতন করা। সবাইকে বোঝানো প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে কত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আমরা বসবাস করছি। এখানকার প্রতিটি পুরোনো জিনিস ইতিহাসের অংশ, যা আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে।’ রহনপুরে একটি সেমিনার আয়োজনের পরিকল্পনাও তাঁর আছে। গবেষকেরা সেখানে যাবেন। তাঁরা যা আবিষ্কার করেছেন, সেসব তুলে ধরবেন।
সংগ্রহের দুই শতাধিক প্রত্নস্মারক নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন মাহির। এগুলো তাঁর মোট সংগ্রহের ১ শতাংশও নয়! নিজের এসব সংগ্রহ নিয়েও ভাবছেন তিনি। এখন তাঁর বাড়িজুড়ে এসব রাখা। সবার দেখার সুযোগ করে দিতে রহনপুরে একটি জাদুঘর করতে চান মাহির। সেই স্বপ্নও নাকি বাস্তবায়নের পথে। মাহিরের সেই জাদুঘর দেখার অপেক্ষায় রইলাম।